বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
মিলু বর্মন
বাইশে শ্রাবণ আমাদের অনন্ত কষ্ট নাকি গভীরতম স্বাদ এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনা। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে অনেকটা ঈশ্বরের মতো কিংবা বাতাসের মতো আমরা গ্রহণ করি বেঁচে থাকি। বাতাসের তো জন্ম মৃত্যু হয়না শুধু বয়ে চলা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। আমাদের সংকটে রবীন্দ্রনাথ আশ্রয়, অন্ধকারে তিনি আবার আলোকবর্তিকা।
‘‘যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি আমি তবে এক্ষুনি হই ইচ্ছামতী নদী’’ শিশু ভোলানাথ এর কবিতা গুলো আজও আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়- ‘‘ ছোট ছেলে হওয়ার সাহস আছে কি এক ফোঁটা তাইতো এমন বুড়ো হয়েই মরি’’ ছোটবেলায় যখন স্কুলের পেরোয়নি তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনেকটা বাড়ির গুরুজেনের মতো আগলে রেখেছে। ‘‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’’- কিংবা ‘‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’’- সেই দুরের থেকেই রবীন্দ্রনাথের সাথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে যায়, তারজন্য রবীন্দ্র গবেষক হবার প্রয়োজন পড়েনা কিংবা পড়ুয়া হিসেবেও বিশেষ কোন সুখ্যাতির দরকার নেই। আমাদের ছেলেবেলা থেকে কবিতার সখ্যতা শুধু কোন বিদ্যালয়ের কিংবা মহাবিদ্যালয় এর পড়ার বাধ্যবাধকতা নয় শ্রেফ ভালোলাগার অনুভূতি ।
রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে আবৃত্তির সূত্র ধরে আমার বাল্যকাল থেকে কৈশোর যৌবন এবং মধ্যম গগনে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করছে।আবৃতির যোগসূত্রে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার কাছে এযুগের এসময়ের। কোন যুক্তিতর্কেই আমরা তাকে ব্যাকডেটেড বলার স্পর্ধা দেখাইনা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো প্রিয় কবির তালিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম না থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েনি এমন মানুষের সংখ্যা একালেও দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংখ্যা ৫২ টি তার সাথে রয়েছে গোটা একটা আকাশ মানে গীতবিতান। ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে ফিরবো আমাদের যৎসামান্য সঞ্চয়ে। প্রথমে আসি রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহ পদাবলী তে, এখানে আমরা নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে পাই সাথে উপরি পেলাম নতুন এক ধরনের ভাষা। ‘‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’’ কিংবা ‘‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে’’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচনা সবটাই তাঁর মাপেই অনন্ত আকাশ ব্যাপিয়া বিস্তৃত। রবীন্দ্রনাথের কাব্য- ‘সন্ধ্যাসংগীত’ ‘প্রভাত সঙ্গীত’ সোনার তরী, ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনী, গীতাঞ্জলি গীতিমাল্য, গীতালি, বলাকা, পূরবী একটি একটি কাব্যগ্রন্থ অভিনবত্বে ভরা। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৮ তখন থেকেই তার কাব্যচর্চার শুরু । প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ কে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা তার নিজস্ব ঢঙে স্বতন্ত্র হিসেবে পাই ।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যে মানবিকতা আনন্দ আর প্রকৃতির অবাধ বিচরণের যে প্রেম মূর্ত – বিশেষ করে সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাত সঙ্গীত, ছবিওগান, সোনার তরী, চিত্রা. চৈতালি এবং কল্পনায় আমরা তাই এ রুপটি পাই। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাত সঙ্গীত, সোনার তরী, ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনী, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালী, বলাকা, পূরবী- কাব্যগ্রন্থ অভিনবত্বে ভরা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বারবার তার কবিতা ভেঙেছেন তা নয় নিজেকে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর করে তুলেছেন। আমাদের ভাবনার বিন্যস্ত থাকা বিশ্বাস- চিন্তাকে করেছেন প্রভাবিত নানা আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন অনেক কথাই প্রচলিত যে, রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে ঝোলা কাঁধে নিয়ে উদাস ভাবে সুন্দর শুদ্ধ উচ্চারণে ঘুরে বেড়াতে হবে- এমন খোঁচাখুঁচি সেকালে একালে চললেও রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে যেতে বাঙালি পারেনি, তার দৈনন্দিন জীবনে তার উৎসবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ। ‘‘ছোট ছেলে হওয়ার সাহস আছে কি এক ফোঁটা তাইতো এমন বুড়ো হয়েই মরি-’’ অথবা ‘‘ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’’ এই কবিতাগুলো ছোট্ট মনে জন্ম দিয়েছিল নতুন নতুন কাহিনী নতুন ভাবনা স্বপ্ন দেখার প্রথম সোপান। এই কথাগুলো হু হু করে মনের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল ভাবনায় ভালোবাসায় -আর বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠছিলেন নিত্যদিনের পরিচিত জন, কাছের মানুষ। রবীন্দ্রনাথের সাথে শিশু-কিশোরের যোগাযোগটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শুরু হয়,- কখনো স্কুলের আবৃত্তি কিংবা পাঠ্যবইয়ের নির্ধারিত কবিতা থেকে কিংবা অন্যেরটা শুনেশুনে। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা-’’ অথবা ‘‘পায়ে ধরি পায়ে ধরি তোমার শরৎবাবু একটা সাধারণ মেয়ের গল্প লেখ তুমি’’ এই যে অনুভূতি নারী হিসেবে ভাবনা ও বিশ্বাসকে আমার মাপের চেয়ে বড় করে দিয়েছিল, বিষয়ের অনুভূতি আমার আমি কে চিনতে সহায়তা করেছে সেকাল এবং আজকের কালে। কবিতার ভেতর থেকে আমি ঢুকে পড়েছি আমারই ব্যক্তিজীবনে – ‘‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ চুনি উঠল রাঙা হয়ে’’- এই যে বিপুল বিস্ময়ে প্রকাশিত হলো আমি, আমার আপনার মাঝে চিনে নেবার চোখ খুলে গেল- এই যে ক্ষুদ্র আমির সাথে বৃহৎ আমির মেলবন্ধন রচিত হলো রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার হাত ধরে ফিরে গেছি আমার ছেলেবেলায়, ফিরেছি প্রেমে দ্রোহে আপন ভাগ্য জয় করিবার প্রত্যয়ে।এই যে নিজের ঘরের কোণ থেকে মন কে কেড়ে নিয়ে ভাগ্য জয়ের স্বপ্ন -সীমাহীন বিশ্ব জগতের সাথে আপনাকে মিলিয়ে নেয়ার যাদুমন্ত্রটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দ্বিধা জড়ানো মনকে আলোর পথ দেখায়, হেরে যাওয়া থেকে বাঁচার সংকল্পে দৃঢ় করে, মনের ক্ষুধা কে ভরিয়ে দেয় ভাবনার নানা ব্যঞ্জনে। বোদ্ধাজনেরা কলমে কিংবা আলোচনায় রবীন্দ্রনাথকে সর্বসাধারণের থেকে দূরে কোন উচ্চমার্গে রাখতেই পছন্দ করেন – যেন কাচের ছোঁয়াচ লাগা রবীন্দ্রনাথকে আর আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে উঠতে দেয় না, অথচ তার কবিতা পড়ে আমরা মিশে যায় আমাদের ব্যক্তি জীবনে। উপভোগ করি দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ সুখ- অনুভব করি। বিরহের মধুরতা কিংবা বিচ্ছেদের বেদনায় বার বার ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথে- হয়তো আমরা রবীন্দ্রসাহিত্য কিংবা তার সব কবিতা পড়ে উঠতে পারবনা , ব্যাখ্যা করতে পারবোনা বিদূষীদের মত তার প্রতিটি পংক্তি কিন্তু আমার নিজস্ব অনুভবে নতুন রূপে ধরা দেবেন রবীন্দ্রনাথ আর ক্রমাগত মন কে শুদ্ধ থেকে নিয়ে যাবে শুদ্ধতার নির্মল আনন্দে। হয়তো একদিন মহাবিশ্বে আমার ক্ষুদ্র আমি কে চিনে নেব- আমি নারী আমি মহীয়সী আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা মিথ্যা হত কাননের ফুল ফোটা।’’ মধ্যবিত্তের লড়াইটা বিন্দু বিন্দু হতে হতে সিন্ধু হয়ে যেন শীতের শেষে ঝরে পড়া পাতাহীন গাছ -সকল শূন্য করে বসে আছে। সেই হা-হুতাশের সহোদর রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো ভালোবেসে বাঁচার লড়াই হয়ে ফিরে আসে বারবার জীবনে ।
আমাদের অবসাদ কান্না, দোসরহীন জেগে থাকা শূন্যরাত হাতরে ফিরে জীবন আর সেই জীবনের মধ্যে আবিষ্কার করে আর একটা জীবন। এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধূলি লগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী তীরে তমালের ঘন ছায়া, আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর। কবিতা সময়কে ধারণ করে তাই কবিতা গতিশীল। কবিতা মানুষকে গভীর থেকে গভীরে নিতে সাহায্য করে । রবীন্দ্রনাথ সেই গতিপ্রবাহের সৌন্দর্য কে কবিতায় সচেতনভাবেই এনেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ সমসাময়িক পুরনো হননি কখনো।
রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে হয়তো আমজনতার কাছ থেকে আজও কিছুটা দূরের তবু রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আমাদের অবচেতন মন ময়ূরের মতো নেচে ওঠে – আকাশের বিশালতায় শ্রাবনসন্ধ্যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে ব্যথাতুর বেদনার । তখন ক্ষুদ্র আমি কখন এসে দাঁড়ায় বিশ্ব আমির আসরে- উচ্চারণ করে সেই দৃপ্ত বাণী ‘‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক আর কিছু নয়- এই হোক শেষ পরিচয়।’’