বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অবস্থা যখন দুর্বল হয়, তখন সামাজিক অপরাধ সবল হইয়া উঠে; সমাজে অস্থিরতা প্রকাশ পাইতে থাকে। এই চিরন্তন সত্য লইয়া জার্মানির বিখ্যাত পলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট ম্যাক্স ওয়েভার ১৯৬৮ সালে একটি ভুবনবিখ্যাত গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন, যাহার শিরোনাম—ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি :অ্যান আউটলাইন অব ইন্টারপ্রেটিভ সোসিওলজি। ১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এই গ্রন্থকে বিংশ শতাব্দীর সমাজবিজ্ঞানবিষয়ক সেরা গ্রন্থ বলিয়া ঘোষণা করে। ওয়েবার সহিংসতাকে রাষ্ট্র তাহার ব্যর্থতা ও দুর্বলতা দিয়ে কীভাবে সামাজিক সহিংসতাকে বৈধতা দেয় এবং স্থায়ী করিয়া তোলে, তাহা ব্যাখ্যা করিয়াছেন।ইহাই শেষ নহে, বিষয়টি লইয়া বিশেষ করিয়া পশ্চিমা বিশ্বে নানা গবেষণা, প্রকাশনা ও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। ২০২১ সালে ইউরোপীয় কমিশন একটি সোশ্যাল ইকোনমিক অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করিয়াছে। তাহাদের বক্তব্যের সারমর্ম হইল—সমাজে ন্যায়বিচার, চাকুরিতে সমান সুযোগ এবং পিছাইয়া পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্মুখে লইয়া আসা একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা না গেলে এবং টেকসই না করা গেলে সামাজিক জীবনে শান্তি আনায়ন করা যাইবে না। এই ক্ষেত্রে তাহারা বৈপরীত্য এবং সংগতিগুলিকে চিহ্নিত করিয়াছেন। সেই অনুসারে যথাযথ পরিকল্পনা লইয়া অগ্রসর হইতেছেন। দুঃখের বিষয়—সমাজ ও অর্থনীতি লইয়া এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা উন্নয়নশীল বিশ্ব গ্রহণ করে বলিয়া আমাদের জানা নাই। উন্নয়নশীল দেশগুলির সবচাইতে বড় দুর্বলতা হইল, যাহারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, তাহারা অতি সাময়িক চিন্তা দ্বারা পরিব্যাপ্ত হন।বিশ্বের প্রতিটি দেশই এই সময়ে অল্পবিস্তর সংকটে রহিয়াছে। কোনো দেশ অর্থনৈতিক সংকটে, তো কোনো দেশ রাজনৈতিক সংকটে অধিক জর্জরিত। বিশেষ করিয়া করোনা মহামারির দুই বৎসর অতিবাহিত হইবার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ অনেক দেশকেই নড়বড়ে করিয়া ফেলিয়াছে; কিন্তু অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ উভয় দিক দিয়াই সংকটে নিপতিত। একদিকে মুদ্রাস্ফীতির ঘাত সবচাইতে অধিক পড়িয়াছে এই দেশগুলিতে, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এই দু্ই পরিস্থিতির বাইপ্রোডাক্ট সামাজিক অপরাধ তাহাদের পরিবেশকে বিষময় করিয়া তুলিয়াছে। অথচ তাহারাই সংকটকে সংকট বলিয়া মনে করেন না। যাহার ফলে এই দেশগুলিকে স্থায়ীভাবে ঘানি টানিতে হয়। যেমন ক্যারিবিয়ার দেশ হাইতি, আফ্রিকার দেশ সুদানের কথা দিয়াই বলা যায়। এই দেশগুলিতে অর্থনৈতিক দুর্বলতা যেমন স্থায়ী, তেমনি আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও স্থায়ী রূপ লাভ করিয়াছে। দেশগুলির সরকার ও জনগণও যেন ঐ অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা ও অস্থির জীবন মানিয়া লইয়াছে; কিন্তু যেই সকল দেশ এই ধরনের সমস্যা হইতে বাহির হইতে চাহে, তাহাদের তো পরিকল্পনা থাকিতে হইবে! হিসাব খুবই সহজ যে, কেহ গাছের সুস্বাদু ফল খাইতে চাহিলে তাহাকে গাছ লাগাইতে হইবে, উহার পরিচর্যা করিতে হইবে, ফল পাকিবার সময় দিতে হইবে, তাহার পর গাছ হইতে ফল পাড়িয়া তাহার স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে। এমনিতেই খাওয়ার টেবিলে ফল আসিবে না।
অতএব, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আজ আমরা যে সামাজিক অস্থিরতা, অসংখ্য অপরাধ দেখিতে পাই, তাহার পিছনে রহিয়াছে অর্থনৈতিকভাবে পিছনে পড়িয়া যাওয়া। ইহা জানিতে হইবে, একটি সমাজে, একটি রাষ্ট্রে একজন মানুষ যদি তাহার শ্রম বিক্রয় করিয়া পেটের আহার জোগাইবার সুযোগ না পায়, তাহা হইলে সে অন্যের মাথায় লাঠি ভাঙিয়া নিজের পেট বাঁচাইতে চাহিবে—ইহাকে চিরাচরিত অলিখিত নিয়মই বলা যায়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়মকে ভাঙিয়া সমাজকে একটি সুস্থ ধারায় লইয়া আসাই একটি রাষ্ট্রের দক্ষ পরিচালকদের কাজ।