শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত মহানবী সা:-এর পৃথিবীর বুকে শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহ তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসব ঈদে মিলাদুন্নবী। ঈদে মিলাদুন্নবী কখনো কখনো মিলাদ হচ্ছে শেষ নবীর জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে পালিত একটি উৎসব। অনেকে দিবসটিকে সিরাতুন্নবী সা: দিবস হিসেবে পালন করেন। মাসব্যাপী মানবতার মুক্তির দিশারীর সিরাত তথা জীবনী আলোচনা করে নিজেদের ঈমানকে দীপ্ত করেন। তবে উৎসব নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে। হিজরি বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখে এ উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশে মুসলমানরা এই দিনকে গুরুত্ব সহকারে পালন করে।
আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বেনিন, ব্রুনাই, বুরকিনা ফাসো, চাঁদ, মিসর, গাম্বিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান, পাকিস্তান, সেনেগাল, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেনে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী।
ঈদে মিলাদুন্নবী এলে মুসলমানের মনে আনন্দের ঢেউ লেগে যায়। চার দিকে মিলাদ-কিয়াম, মাহফিল, আলোচনা, হামদ্-নাত মজলিস, বর্ণাঢ্য র্যালিসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন কুল কায়নাতের শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:। নবী হিসেবে সব নবীর শ্রেষ্ঠ নবী তিনি। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাঁর চেয়ে সেরা আর কেউ নেই। তাই তো তাঁর আগমনে আনন্দে মেতে উঠে নিখিল প্রকৃতি। ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ-খুশি, আনন্দ, উল্লাস ও ফুর্তি। আর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা: হচ্ছে নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা:-এর শুভাগমন বা জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ উৎসব। কারণ রাসূল সা: গোটা মানবজাতির জন্য এমনকি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত ও আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া-১০৭) আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসূল! আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-সাবা-২৮)
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:-এর গুরুত্ব এই, মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মুক্তিদাতা ১২ রবিউল আউয়াল, ২৯ আগস্ট ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে শুভাগমন করেন। তাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানবগোষ্ঠীকে এ পৃথিবীতে অত্যাচার, দুর্নীতি, সব প্রকার জুলুম-নির্যাতন ও অন্যায় থেকে মুক্তিদানে সুখ-শান্তি ও সৎপথে পরিচালনা এবং মৃত্যুর পরপারে জাহান্নামের অগ্নি থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে চিরসুখময় জান্নাতের যোগ্য করে গড়া। এভাবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: দুনিয়াতে ইসলাম ধর্মের মিশন শান্তির বাণী নিয়ে আগমন করেন।
গোটা মানব জাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত ও সব নবী-রাসূলের নবী পরিশেষে আগমন করেন। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য। কারণ তারপর দুনিয়াতে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। এই মর্মে রাসূলুল্লাহ সা: বাণী দিয়েছেন যে, ‘অন্য নবীগণ তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন আর আমি বিশ্বের সমগ্র মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’
নবী করিম সা: আরো ঘোষণা করেছেন, ‘আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’ (সহিহ আল-বুখারি) মক্কায় কুরাইশ সম্প্রদায় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর কাছে আল্লাহর পরিচয় জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সা: নবুওয়ত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়ে বিশ্বের মানুষকে তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানালেন, ‘বলুন (হে মুহাম্মদ!) আল্লাহ এক, আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো থেকে জন্মও নেননি, আর কেউ তার সমকক্ষ নয়।’ (সূরা আল-ইখলাস: ১-৪)
এখানে আমরা পবিত্র ঈদের মিলাদুন্নবী সা:-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করছি যে, মহানবী সা: মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং তাদের সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন, যাতে তারা জীবনের সফলতা অর্জনে একে ফলপ্রসূ করতে পারে আর ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়। হজরত মুহাম্মদ সা: প্রথমত আল্লাহর একত্ববাদ ও ধর্মের মৌলিক আইন-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসূল।’
হজরত মুহাম্মদ সা: এমন এক সমাজে আবির্ভূত হন, যেখানে লোকেরা তাদের মানবিক গুণাবলি ও চারিত্রিক আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতে তাঁর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন (হে রাসূল) তোমরা আল্লাহর ও তার রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা আল ইমরান-৩২) অন্য আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে, ‘ওহে, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা আল-নিসা-৫৯)
আল্লাহর তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়। কারণ, রাসূল সা: যা কিছু বলেছেন যা নির্দেশ করেছেন তার ওহি বা প্রত্যাদেশের দ্বারাই করেছেন। পবিত্র কুরআনে এই মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (রাসূল) মনগড়া কিছুই বলেন না, (তিনি যা বলেছেন তা প্রত্যাদেশকৃত ঐশীবাণী ব্যতীত আর কিছু নয়।’এ জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শবাণী অনুসরণ ও তার শিক্ষা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সুন্দরতম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব-২১)
রাসূলুল্লাহ সা: উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বলে বিরোধী কাফিররাও তাকে ‘আল-আমিন’ তথা ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল এবং তার এই সৎ চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আল্লাহ তায়ালা নবীকুল শিরোমণির উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আল কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা আল-কালাম-৪)
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের সংবিধান মেনে চলার জন্য বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি নির্দেশ (বস্তু) রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এর অনুশাসন মেনে চলবে তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো- আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন) এবং তার প্রেরিত রাসূলের চরিত্রাদর্শ (আল-হাদিস)।’ (মিশকাত)
বস্তুত বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে সেখানে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম আদর্শ গ্রহণ করে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:। আমাদের সবার মনে সহনশীলতা, সংযম, হৃদ্যতা, সম্প্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে সহায়ক হোক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম, সুন্দরতম, মহত্তম, রাহমাতুল্লিল আল-আমিন, পেয়ারা নবী মোহাম্মদ মোস্তফা সা:। তিনি আর আসবেন না, তবে তিনি আছেন, থাকবেন, তিনি অমর, তিনি চিরঞ্জিব।
সাড়ে ১৪০০ বছর আগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের হিজরি ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মলাভ করেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এ রাসূল সা:। ইসলামের সুমহান দ্বীন ও জীবনবিধান প্রচার শেষে ৬৩ বছর বয়সে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ১১ হিজরির এ দিনে ইন্তেকাল করেন তিনি। এ জন্য দিনটি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এ মহামানবের জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হলেও মুসলিমরা দিনটিকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা: বা জন্ম-উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।
লেখক : কবি-সাহিত্যিক, সমালোচক