শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
সামাজিক ও অর্থনৈতিক—দুই ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ধাপে ধাপে সরকার মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করে। কোভিড-১৯–এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারঘোষিত যে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে, তার মধ্যে ৫টির বাস্তবায়নের হার খুবই শোচনীয়। এগুলোতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। কিন্তু গত জুন পর্যন্ত এগুলো থেকে খরচ হয়েছে ৮০৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের বেশি সময় ধরে পাঁচ প্যাকেজ থেকে ১১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকাই খরচ হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ৩০ জুন পর্যন্ত পুরো ২৩ প্যাকেজের বাস্তবায়ন অগ্রগতির যে চিত্র সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে, তা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
২৩ প্যাকেজের মোট আকার ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে অপর পাঁচটির বাস্তবায়ন হার এমনকি শত ভাগও ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই ১০টি বাদে অন্য ১৩ প্যাকেজের বাস্তবায়ন হার আছে মাঝামাঝি অবস্থায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, ১৪ মাসে মোট অর্থের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯৬ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
যে উদ্দেশ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন না হলে তো কিছুই হলো না। দুটি দিক আছে। সরকারের দিক থেকে হয়তো নীতি সমস্যা আছে, আবার শর্ত শিথিল করলেও টাকার অপব্যবহার হতে পারে।
মাহবুব আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব
এদিকে গত মাসে (জুলাই) ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার আলাদা পাঁচ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। সে হিসাবে মোট প্যাকেজ দাঁড়ায় ২৮টি, আর অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। শেষের পাঁচটির বাস্তবায়ন চিত্র এখনো তৈরি করেনি অর্থ বিভাগ।
শোচনীয় প্যাকেজগুলোর সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, তৈরি পোশাক ও চামড়াশিল্পের দুস্থ শ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিজীবী এবং করোনা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীরা। আর সফল প্যাকেজগুলোর উপকারভোগীরা হচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পশ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
করোনার কারণে তৈরি হওয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক—দুই ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে প্যাকেজগুলো ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য প্যাকেজগুলোতে জড়িত অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। বাকি প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের।
বাস্তবায়নের খারাপ অবস্থার কারণ জানতে গেলে অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কর্মচারী কথা বলতে রাজি হননি। তবে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে উদ্দেশ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন না হলে তো কিছুই হলো না। দুটি দিক আছে। সরকারের দিক থেকে হয়তো নীতি সমস্যা আছে, আবার শর্ত শিথিল করলেও টাকার অপব্যবহার হতে পারে। এখন দরকার হচ্ছে বহুপক্ষীয় বৈঠক করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া।’
এ প্যাকেজ থেকে ওইভাবে অর্থ ব্যয় না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে টাকা ছাড়ের শর্তে সমস্যা। যে সময়ে টাকা দেওয়া হয়, তাতে রপ্তানিকারকদের খুব বেশি লাভ হয় না। গভর্নরকে জানানোর পর বলেছিলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন। পরে আর তেমন কিছু হয়নি। ফারুক হাসান, সভাপতি, বিজিএমইএ
বাস্তবায়নে শোচনীয় ৫ প্যাকেজ
রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণসহায়তা দিতে ‘প্রাক্–জাহাজীকরণ ঋণ পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি’ নামক একটি প্যাকেজে রাখা হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাস্তবায়ন শুরু হয় গত বছরের ১৩ এপ্রিল থেকে। অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, প্রথম ছয় মাসে এ থেকে পুনঃ অর্থায়ন নিতে আবেদন জমা পড়ে মাত্র একটি। অথচ ৩১টি ব্যাংক পুনঃ অর্থায়ন নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ বছরের জুন পর্যন্ত এই প্যাকেজ থেকে দেওয়া হয়েছে ২৯১ কোটি টাকা। এ প্যাকেজ থেকে নেওয়া ঋণের মেয়াদ এক বছর। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো নেবে ৩ শতাংশ সুদে, আর গ্রাহক ব্যাংকগুলোকে দেবেন ৫ শতাংশ সুদ। বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্যাকেজের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। প্যাকেজটির ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা পড়ে আছে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ প্যাকেজ থেকে ওইভাবে অর্থ ব্যয় না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে টাকা ছাড়ের শর্তে সমস্যা। যে সময়ে টাকা দেওয়া হয়, তাতে রপ্তানিকারকদের খুব
বেশি লাভ হয় না। গভর্নরকে জানানোর পর বলেছিলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন। পরে আর তেমন কিছু হয়নি।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে দুই হাজার কোটি টাকার ‘এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম’ প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে গত বছরের ২৭ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজ থেকে খরচ হয়েছে ২৯ কোটি টাকা। পড়ে আছে ১ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা।
‘কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্যাকেজে বরাদ্দ ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত এ থেকে খরচ হয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া করোনা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা এবং জীবনবিমা খাতে বরাদ্দ আছে ৭৫০ কোটি টাকা। এ থেকে জুন পর্যন্ত খরচ হয় ৭০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া পোশাক ও চামড়া খাতে কাজ হারানো শ্রমিকদের তিন মাস ধরে তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার জন্য আছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ। বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত এপ্রিল পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৫ জন শ্রমিকের জন্য মাত্র ছয় কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। জুন পর্যন্ত আর বাড়েনি অর্থাৎ ওই ছয় কোটিই খরচ। পড়ে আছে ১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শ্রম অধিদপ্তরের।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গৌতম কুমার গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্যাকেজটি নিয়ে নতুন করে ভাবা
হচ্ছে। এ জন্য কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। পোশাক ও পাদুকাশিল্পের বাইরে অন্য কোনো খাতের শ্রমিকদের অর্থসহায়তা দিতেও এ প্যাকেজের অর্থ ব্যবহার করার জন্য ইইউর সঙ্গে দর-কষাকষি চলছে।’
শতভাগ বাস্তবায়িত ৫ প্যাকেজ
পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ তহবিল’ প্যাকেজটি প্রথম প্যাকেজ। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ের বেতন-মজুরি দিতে এটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সার্ভিস চার্জ ২ শতাংশ। কারখানার মালিকেরা এ ঋণ নিয়ে বেতন-মজুরি দিয়েছেন। যদিও জুন মাসের বেতন-মজুরি দেওয়ার আগেই টাকা শেষ হয়ে যায়। পরে তহবিলের আকার প্রথমে ২ হাজার ৫০০ কোটি ও পরে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্যাকেজের আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সুবিধা ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়। ফলে অতিরিক্ত যোগ হয় ১৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। পরে অর্থ আরও বাড়িয়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্যাকেজের আকার করা হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ৫৬টি ব্যাংকের মাধ্যমে এ প্যাকেজ বাস্তবায়িত হয়। ৩০ জুন পর্যন্ত পুরো অর্থই খরচ হয়।
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী বাবদ ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় গত বছর।
জুন পর্যন্ত খরচ হয় ১১০ কোটি টাকা। এদিকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিতে প্রথমবার ২৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পরে এটি বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ৭৭০ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত পুরো টাকাই ব্যয় হয়। ‘গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণ’ প্যাকেজে বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজের আওতায় খরচ হয় ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা।