বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

গ্রামীণ জনপদে সাশ্রয়ী জ্বালানি বায়োগ্যাস

গ্রামীণ জনপদে সাশ্রয়ী জ্বালানি বায়োগ্যাস

অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে মূলত বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। গ্রামগঞ্জে অধিক ব্যয়ভারের কারণে জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ, এলপি গ্যাস বা কেরোসিনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এসবের বিকল্প হিসেবে আজও গ্রামগঞ্জে প্রধান জ্বালানি হিসেবে কাঠ, গাছের পাতা, খড়কুটার ব্যবহার অধিক প্রচলিত। কোথাও স্বল্পপরিসরে গোবরের ঘুঁটের ব্যবহারও প্রচলিত রয়েছে। বনভূমি হ্রাসের কারণে গ্রামীণ জনপদে আজ জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ায় বায়োগ্যাসকে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন। কারণ বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ যেমন ব্যয়বহুল নয়, তেমন একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট চালানোর প্রধান উৎস গ্রামগঞ্জে সহজলভ্য। জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামীণ জনপদে অনেকেই গবাদি পশু গরু, ছাগল এবং হাঁস-মুরগি পালনে করে থাকেন। পেশা হিসেবে পশুপালন অনেকের জীবনে সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। দেশে প্রতি বছর ১২৪.১৫ মিলিয়ন টন গবাদি পশুর বর্জ্য সৃষ্ট হয়, যা দিয়ে বিপুল পরিমাণ বায়োগ্যাস এবং প্রাকৃতিক সার উৎপাদন সম্ভব। দেশের ৪৩ কোটি গবাদি পশুর বর্জ্য ব্যবহার করে গ্রামীণ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ বায়োগ্যাস উৎপাদিত হতে পারে। এ বায়োগ্যাস দিয়ে রান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জৈব সার তৈরি করা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস উৎসারণ কমিয়ে পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ বায়োগ্যাস প্লান্টের সম্ভাবনা থাকলেও মাত্র ১.৫ লাখ বায়োপ্লান্ট এ পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের অধীনে জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে একটি তিন ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদনক্ষম বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করে। তখন এর নির্মাণ ব্যয় ছিল মাত্র ১২ হাজার টাকা। পরবর্তীকালে জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ছাড়াও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসংস্থা বেশ কিছু বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণে উৎসাহী হয়। জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে কাটা হয় বিপুল পরিমাণ গাছপালা।

ব্যয়বহুল হলেও বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে সারা দেশে এলপি গ্যাস প্রসার লাভ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন, সেচপাম্প চালাতে এবং বাতি জ্বালাতে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও কয়লা আমদানি করতে হয়। এজন্য খরচ হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। বাধাগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কখনো সময়মতো সেচ দিতে ব্যর্থ হলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। এ পরিস্থিতিতে কাঠের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার শুরু না করা হলে বাংলাদেশে অচিরেই বনভূমি স্বল্পতাজনিত ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। বায়োগ্যাস ব্যবহারের প্রসার এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে যতসংখ্যক গরু, মহিষ রয়েছে ছাড়াও ভেড়া, ছাগল ও হাঁস-মুরগির মতো ছোট ছোট প্রাণীর বিষ্ঠা এবং কচুরিপানার মতো জলজ উদ্ভিদসহ জৈব আবর্জনা বায়োগ্যাস উৎপন্নের কাজে ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

অল্প পরিশ্রম এবং স্বল্প ব্যয়ে একটি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাত-আটজন সদস্যের একটি পরিবারের জন্য তিন ঘনমিটার বায়োগ্যাস উৎপাদনক্ষম একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের জন্য ২৫০ সেন্টিমিটার ব্যাসের এবং ২২০ সেন্টিমিটার গভীরতার একটি ডাইজেস্টারই যথেষ্ট। বায়োগ্যাস প্লান্টের ডাইজেস্টার কূপের সঙ্গে দুই স্টেজে ১০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ১৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ১১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা এবং ১৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ১৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ৬০ সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট আয়তকার হাইড্রোলিক কক্ষ তৈরি করতে হবে। এর ওপর ২১০ সেন্টিমিটার অভ্যন্তরীণ ব্যাস রেখে ১২.৫ সেন্টিমিটার পুরু এবং ২৫ সেন্টিমিটার উঁচু ইটের দেয়াল নির্মিত হবে। হাইড্রোলিক চেম্বারের দেয়ালের দরজার উচ্চতা রাখতে হবে ১ মিটার এবং এর ওপর আরও ৪০ সেন্টিমিটার উঁচু ইটের দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। দেয়ালের ওপর ১:২:৪ অনুপাতে ৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু কংক্রিটের ঢালাই দিতে হবে। ঠিক এর ওপর ৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু এবং ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু আর্চবিশিষ্ট গম্বুজ আকৃতির ডোম নির্মিত হবে। এর উপরাংশে গ্যাস নির্গমনের জন্য ১.২৭ সেন্টিমিটার ব্যাসের ও ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা জিআই পাইপ খাড়াভাবে স্থাপন করে তার ওপর গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ভালভ সংযুক্ত থাকবে। কক্ষের দেয়ালের উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার নির্মিত হলে স্লারি নির্গমনের জন্য একটি পথ রাখতে হবে। ইনলেট পাইপের মুখে একটি ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকৃতি ও ১২.৫ সেন্টিমিটার পুরু ইটের গাঁথুনির ট্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে। বায়োগ্যাস প্লান্টে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য প্রথমত ১.৫ থেকে ২.০ টন গোবর, মানুষ ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে ১:১ হতে ১:৩ অনুপাতে পানি মিশিয়ে ইনলেট পাইপ দিয়ে ধীরে ধীরে ডাইজেস্টার কূপে ঢেলে দিতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ গোবরে কূপটি পূর্ণ না হলে বাকি অংশ পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। কূপের মধ্যস্থিত পচনশীল দ্রব্য থেকে ধীরে ধীরে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়ে জিআই পাইপের মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে এবং পাইপ সংযোগের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যেতে হবে। সংযুক্ত ভালভের সাহায্যে গ্যাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ গ্যাস থেকে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করা এমনকি বৈদ্যুতিক বাল্ব ও হ্যাজাক লাইট জ্বালানো, জেনারেটর, ফ্যান, রেডিও, টেলিভিশন চালানো সম্ভব হবে। ডাইজেস্টার কূপে উৎপন্ন বায়োগ্যাস ব্যবহারের পর কূপের নিচে জমাকৃত বর্জ্য থেকে উন্নতমানের জৈব সার প্রস্তুত করে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি এসব বর্জ্য হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি বায়োগ্যাস প্লান্টকে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ৩০ বছর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

বর্তমান জ্বালানি সংকট সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষের জন্য স্বস্তি এনে দিতে পারে। শহরাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ বর্জ্য আবর্জনা দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপন্ন সম্ভব। এ কাজে পোলট্রি শিল্পের বর্জ্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি ১.২ থেকে ১.৩ ঘনমিটার সামর্থ্যের বায়োগ্যাস প্লান্ট দিয়ে গৃহস্থালি এবং মাঝারি আকারের গবাদি পশুপালন ফার্মের চাহিদা মেটানো সম্ভব। দেশে প্রায় ২২ মিলিয়ন গরু ও মহিষ রয়েছে, যা থেকে ০.২২ মিলিয়ন টন গোবর মেলে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩ জেলার প্রায় এক মিলিয়ন পশুপালনকারী মানুষের জীবিকা নির্বাহের কাজে দুধ এবং মাংস বিক্রির বাইরেও পশুর বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস জ্বালানি উৎপাদনসহ পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বায়োগ্যাস ব্যবহারের প্রসার লাভের লক্ষ্যে প্লান্ট স্থাপনের জন্য জনগণকে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় হ্রাসের ব্যাপারেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কথাও বিবেচনায় আনা দরকার। একটি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে কতটা রান্নার চুলা জ্বালানো যায় এবং তা দিয়ে পরিবারের কতজন সদস্য উপকৃত হতে পারে, সেই ব্যাপারে তাদের বিশদ ধারণা দেওয়া জরুরি। ২০৪০ সাল নাগাদ কম ব্যয়ে ৫০ শতাংশ বেশি বায়োগ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে। বায়োগ্যাস ব্যবহারের কারিগরি সুবিধার বিষয়ে গ্রামীণ জনগণ অবহিত হলে এর প্রসার লাভ সম্ভব।

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০