মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ নিজ নির্বাচনী এলাকা কসবা-আখাউড়ায় গিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রায়ই বলতেন, ‘মন্ত্রী হয়ে আমার লোকসান হয়েছে। আমার আয় কমে গেছে। আগে আদালতে গিয়ে আইনজীবী হিসেবে পেশাগত কাজ করতে পারলেও এখন সেটা করতে পারি না।’
তার এই সরল কথায় স্থানীয়রা তখন বুঁদ হলেও বাস্তবতার বিভ্রম কাটে এখন, যখন তারা দেখলেন, আয় কমলেও আনিসুল হকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে দ্বিগুণ। তিনি দুটি ব্যাংকের মালিকানায় নাম লিখিয়েছেন। সিটিজেন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে তার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
যদিও স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি, সিটিজেন ব্যাংকের মালিক মূলত আনিসুল হক। তার মা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহানারা হকের নামেই ব্যাংকের অনুমোদন করান তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী তার মন্ত্রিত্বকে পুঁজি করে বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। তারা মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য, চোরাচালান, ভূমি দখল করে হাতিয়ে নিয়েছেন এসব টাকা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছেন বিভিন্ন মামলা দিয়ে।
তাদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাবেক পিএস রাশেদুল কায়সার ভূঁইয়া জীবন মন্ত্রীর খুবই ঘনিষ্ঠজন। এ ছাড়া আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মো. তাকজিল খলিফা কাজল ও তার আপন ভাই ফোরকান আহমেদ খলিফা, আখাউড়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মুরাদ হোসেন, আনিসুল হকের পিএ মো. আলাউদ্দিন বাবু, শফিকুল ইসলাম সোহাগ বিভিন্ন দুর্নীতি, চোরাচালান ও নিয়োগ-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে দলীয় ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান।
উপজেলার বিনাউটি ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি সবুজ খান জয় কালবেলাকে বলেন, আনিসুল হক তৃতীয়বারের মতো আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে কসবা-আখাউড়ায় নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করেন। এ জন্য ভিন্নমত ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেছেন। মামলা দিয়ে দিনের পর দিন অন্যায়ভাবে জেলে খাটিয়েছেন।
সবুজ বলেন, শুধু তা-ই নয়, তিনি তার বিশেষ ক্ষমতায় আইনে অনেককে গুম করে নিয়ে নির্যাতন করতেন। যার প্রমাণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থী মাওলানা জসিমউদ্দিন। তাকে তখন গুম করে ফেলেন আনিসুল হক। তিনি তার একান্ত সচিব রাশেদুল কাওছার ভূইয়া জীবনকে দিয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করেন। যার প্রমাণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ২৮১ গুণ সম্পদ বৃদ্ধির তথ্যে প্রকাশ হয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাবেক এ পিএস রাশেদুল কায়সার ভূঁইয়া জীবন তারা একে অপরের মাদক সিন্টিকেটের কথা তুলে ধরেন।
গত ১৪ মে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এক জনসভায় উপজেলা কায়ুমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকতিয়ার আলম রনি বলেছিলেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাবেক এপিএস ও কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল কাউসার ভূঁইয়া জীবন মাদকের সিন্ডিকেট ও মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী বর্তমানে জেলে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অভিযুক্ত অন্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কসবা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফুল হক স্বপন কালবেলাকে বলেন, সাবেক আইনমন্ত্রীর দেওয়া মিথ্যা মামলায় বিএনপির কোনো নেতাকর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় জর্জরিত ছিল নেতাকর্মীরা। আমাকে মিথ্যা অস্ত্র ও হত্যা মামলা দিয়ে ছয়বার জেল খাটানো হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে দীর্ঘদিন আমাকে অত্যাচার করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ তুলে বলেন, কসবা-আখাউড়ার বিএনপির ১৬ জন নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হক ছিলেন টাকার গাছ, আর কসবা-আখাউড়ার স্থানীয় নেতারা ছিল সে গাছের ফল। অনেক নেতাকর্মীর একসময় টেনেটুনে সংসার চলত। কিন্তু বছর পাঁচেক যাওয়ার পরেই একেকজন কোটিপতি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের তিনবারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। হামলা ও গ্রেপ্তার এড়াতে আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষ নেতাদের মতো তিনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
পরে ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে পলায়নরত অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে (২৪) হত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বর্তমানে তিনি একাধিক মামলায় কারাগারে আছেন।