মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪
দক্ষিণ কোরীয় লেখক হ্যান কাং ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন, ‘তার তীব্র কাব্যিক গদ্যের জন্য, যা ঐতিহাসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হয় এবং মানবজীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে’। মাত্র ৫৩ বছর বয়সী এ নারী লেখক প্রথম দক্ষিণ কোরীয়, যিনি এ পুরস্কার পেলেন এবং সাহিত্যে এ পর্যন্ত ১২১ জন বিজয়ীর ভেতর তিনি অষ্টাদশতম। একই সঙ্গে তিনি একজন সংগীতজ্ঞ এবং দৃশ্যশিল্পকলায় আগ্রহী।
হ্যানের সেরা উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ (২০০৭ সালে কোরিয়াতে প্রকাশিত) ২০১৫ সালে প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ২০১৬ সালে এ বইটি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয় এবং পুরস্কারের অর্থ হ্যান কাং ও তার অনুবাদক ডেবোরাহ স্মিথের ভেতর সমান ভাগে ভাগ হয়।
এ সময় স্মিথের অনুবাদ মূল গ্রন্থের মূলানুগতা কতটা রক্ষিত হয়েছে সে বিষয়ে বিতর্কের ঝড় তোলে। কিন্তু এটাই অনুবাদ সাহিত্যের সৃজনশীল সৌন্দর্য-অনুবাদ নিজেই যেখানে একটি সৃষ্টি: এটি একটি কল্পনাপ্রবণ অনুশীলন, অক্ষরে অক্ষরে তর্জমা নয় এবং হ্যান কাং এ প্রশ্নে তার অনুবাদকের পাশেই দাঁড়িয়েছেন।
হ্যান কাংয়ের মোট ছয়টি বই এ পর্যন্ত ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ই তাকে প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’, ‘দ্য হোয়াইট বুক’, ‘ইউরোপা’ ও ‘গ্রিক লেসনস’। ২০১৩ সালে তার মিতায়তণ কাজ ‘আরোগ্য লাভ’ একটি দ্বিভাষিক সংস্করণে প্রকাশিত হয়। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘আমরা আলাদা হই না’ ১৯৪৮-৪৯ সালের জেজু বিদ্রোহ (সমাজতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী ভুবনের শীতল যুদ্ধের সময়ে কোরীয় উপদ্বীপের বিভক্তি) এবং লেখকের এক বন্ধুর পরিবারে দুই কোরিয়ার বিভাজনের বেদনা নিয়ে রচিত, যা ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে।
পৃথিবীতে পরিসর নেওয়া : ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ যেন দৈনন্দিন নিষ্ঠুরতার এক বিভীষিকাময় কাহিনি। উপন্যাসটি তিনটি অঙ্কে বিধৃত যেখানে একজন খুবই ‘অনুল্লেখ্য’ এক নারী মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মেয়েটি তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে অভাবনীয় সব নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। যদিও তার পরিবারের সদস্যরা তার স্বাস্থ্যের কথা ভাবার দাবি করছিলেন, মূলত তারা কাহিনির নায়িকার চরিত্রের অনমনীয়তা মেনে নিতে চাননি। কাহিনির অন্তিমে মেয়েটি নিজেকে উদ্ভিদ বলে ভাবা শুরু করলে জল এবং সূর্যালোক ব্যতীত অন্য কিছু থেকেই সে আর পুষ্টি নিতে রাজি হয় না।
নোবেল কমিটি হ্যানের চরিত্রগুলোর ভেতর ‘অসহায়, প্রায় ক্ষেত্রেই নারী জীবনের প্রতি দৈহিক সমবেদনা’র প্রশংসা করেন।
‘গ্রিক লেসনস’ একজন নারীর মুখে বর্ণিত যিনি তার মাকে হারিয়েছেন, তার ছেলে রয়েছে; ছেলের বাবা বা নারীটির প্রাক্তন স্বামীর অভিভাবকত্বে এবং তিনি ধীরে ধীরে তার কথা বলার ক্ষমতা হারাচ্ছেন এবং কাহিনির অন্যপ্রান্তে রয়েছেন একজন পুরুষ যিনি তার পরিবার এবং স্থানের সঙ্গে সম্পর্ক হারাচ্ছেন, একই সঙ্গে হারাচ্ছেন তার চোখের দৃষ্টি। এ পুরুষটি প্রাচীন গ্রিক ভাষা শেখান; নারীটি তার ছাত্রী হয়।
হ্যান কাংয়ের অন্য অনেক কাজের মতোই, ‘গ্রিক লেসনস’ও উদ্দীপক এবং ল্যাঁকোনীয় গদ্যের মাধ্যমে যা কিছু প্রকাশ এবং ভাগ করে নেওয়া যায়, তার মধ্যবর্তী ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল পরিসরকে উন্মোচন করে আর অনির্বচনীয় যা কিছু বাকি, যা রয়ে যায়, তা থেকে যায় শব্দের সীমার ওপারে। এই উপন্যাস সংযোগের জন্য মানবীয় অনুসন্ধানের শক্তিকে দেখায়; এমনকি শোক ও ক্ষতির ভেতরেও।
‘গ্রিক লেসনস’ বইটি রিভিউ করতে গিয়ে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এই বলে উপসংহার টেনেছে—‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে হ্যান কাংয়ের নারী চরিত্ররা যেভাবে সংগ্রাম করে, ঠিক সেভাবেই তার সাহিত্যিক কণ্ঠস্বর পৃথিবীতে জায়গা করে নেয়।’
তার আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘দ্য হোয়াইট বুক’ ঝকঝকে, স্পর্শকাতর এবং একই সঙ্গে রহস্যময় চরিত্রের এ বই ২০১৮ সালে পুনরায় ‘দ্য ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার’-এর জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়। এটি যেন একটি শিল্পকলার বই, এক দীর্ঘায়িত কবিতা এবং পৃথিবীর যাবতীয় শুভ্র বস্তুবিষয়ক দৃশ্যত এক সাদা গ্রন্থ।
ল্যাঁকোনীয় ভঙ্গিমায় বইটি শুরু হচ্ছে এভাবে, ‘বসন্তকালে, যখন আমি শুভ্র বস্তুরাজি নিয়ে একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নিই, প্রথম যে কাজটি আমি করেছিলাম, তা হলো একটি তালিকা তৈরি করা।’
নবজাতক শিশুকে প্যাঁচানোর কাপড়, নবজাতকের পরিচ্ছদ, লবণ, বরফ, চাঁদ, ভাত, তরঙ্গসমূহ, ইউলান বা চৈনিক ম্যাগনোলিয়া ফুল, সাদা পাখি, ‘শুভ্র ভাবে হাসা’, সাদা কাগজ, সাদা কুকুর, সাদা চুল, শবদেহ আচ্ছাদনের কাপড়—শুভ্র এই বস্তুরাজির তালিকা থেকে একটি আত্মজৈবনিক কাহিনি উন্মোচিত হওয়া শুরু করে যেখানে এক নবজাতক বোনের মৃত্যুর কথা জানা যায় (পৃথিবীতে আসার দুই ঘণ্টার ভেতর যে মারা যায়) এবং লেখকের জন্মের বেশ কয়েক বছর আগেই যার জন্ম হয়েছিল। এই আখ্যানে নানা কণ্ঠের সম্মিলিত ধ্বনি বা কোরাসের স্বর শুনতে পাওয়া যায়, তবে মাঝেমধ্যে লেখক নিজেও তার চির অদেখা বোনকে প্রশ্ন করেন, জানান আর্তিময় নিবেদন।
ওয়ারশতে লেখক হিসেবে এক রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে থাকার সময়ে হ্যান কাং এই ধ্যানস্থ, অতীন্দ্রিয় বইটি রচনা করেন। এই আখ্যানে তুষারের শুভ্রতা মিশে যায় স্মৃতির শুভ্রতার সঙ্গে।
এভাবে লেখাই যেন লেখকের কাছে এক শুদ্ধিকরণমূলক কৃত্য হয়ে ওঠে—বোনের মৃত্যুর পুনর্নির্মাণ যেন বাঁচতে শুরু করা। ফল হিসেবে প্রতিবিম্বগুলো যেন এক প্রার্থনামন্ত্রের ছন্দে অনুনাদিত হয়। এই প্রার্থনামন্ত্র যদিও ধর্মনিরপেক্ষ, তবু গভীরভাবে মানবিক এক প্রার্থনা। শোক প্রকাশের এবং একই সঙ্গে নৈতিকভাবে বাঁচার একমাত্র উপায় যেন স্মৃতির ঝলকের অনিঃশেষ ভগ্নাংশের ভেতর জীবনের প্রবাহ বহমান রাখা।
একটি জাতির শোক প্রকাশ : ‘হিউম্যান অ্যাক্টসে’ এই আত্মজীবনীমূলক শোক প্রকাশ একটি গোটা জাতির শোক প্রকাশের বিষয় হয়ে ওঠে। ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ ১৯৮০ সালের মে মাসে কাংয়ের জন্মস্থান গোয়াংজুতে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে ভয়ানক সামরিক একনায়ক চুন দো-হোয়ানের কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা বিক্ষোভ আন্দোলনে যোগ দিলে সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করে। এসব নৃশংস ঘটনাবলির মাঝেই, আপাতবিরোধী মনে হলেও সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হিসেবে দেখা দেয়—সংহতি, আত্মমর্যাদাবোধ, ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার শক্তি এবং সর্বোপরি, বেঁচে থাকা ও নিহতদের স্মরণে রাখার কাজটি করে চলা।
‘আমার উপন্যাসগুলো মানবীয় যন্ত্রণার কথা বলে,’ হ্যান কাং একবার বলেছিলেন। যখন তিনি গোয়াংজু গণহত্যা বিষয়ে লেখেন, তখন তিনি ‘সচেতন ছিলেন যে পাঠকদের এমন মর্মন্তুদ যন্ত্রণা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে’।
এ উপন্যাসের নৈতিক পরিসর সেন্সরশিপ আরোপের মাধ্যমে রাষ্ট্র যে সমষ্টিগত বিস্মরণ প্রক্রিয়ার আয়োজন করেছিল, তার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ। এ উপন্যাস যেন বা গির্জায় গাওয়া সংগীতের মতো পবিত্র এক সংগীত যেখানে জীবিতদের মৃতদের সঙ্গে, বর্তমানকে অতীতের সঙ্গে, স্মৃতিকে সেন্সরশিপের সঙ্গে এবং শব্দরাজিকে মূলত অমানবিক এক সন্ত্রাসের অকার্যকারিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বেঁচে বা টিকে থাকাই কি বোধহয় মৌন সম্মতির একটি আঙ্গিক হতে পারত?
তবে ‘দ্য হোয়াইট বুক’-এ যেমন নৈঃশব্দ্য যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে লেখায় ঝরে পড়ে, হয়ে ওঠে এতটাই উচ্চকিত, যা সহ্য করা কঠিন। লেখকের ভূমিকা হলো জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও সৃষ্টি করা, স্মরণ করা, যোগাযোগ অসম্ভব বিষয় বা বস্তুকেও পৌঁছে দেওয়া।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের আঙ্গিকে হলেও, নৈঃশব্দ্যের মাধ্যমে হলেও, এমনকি যখন মানবতাকে আমাদের কাছে ব্যর্থ বলে মনে হয় তখনো।
এসবের জন্য এবং আরও নানা কিছুর জন্যই হ্যান কাং এ বছর সাহিত্যে নোবেলের জন্য যথাযোগ্য দাবিদার।
[ভ্যালেন্তিনা গোসেত্তি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ডে ফরাসি সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। ‘দ্য কনভার্সেশন’ পত্রিকায় হ্যান কাংকে নিয়ে তার এ লেখাটি গত ১০ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।