বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
প্রখ্যাত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া শব্দদূষণ লইয়া লিখিয়াছেন- ‘শহরের পাতি কাক ডাকে ঝাঁকে ঝাঁকে/ঘুম দেয়া মুশকিল হর্নের হাঁকে।’ কবিতাটিতে কবির প্রথম দিকের বর্ণনায় দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণী, যেমন-গরু, হাঁস, কবুতর, দোয়েল, চড়ুই, ঘুঘু, টুনটুনি প্রাকৃতিকভাবে ডাকিয়া যায়। ইহা প্রকৃতির এক সুমধুর সংগীতের ন্যায় মনে হয়, যাহা মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। কিন্তু শহুরে জীবনে সেই সুমধুর সুরের পরিবর্তে যানবাহনের হর্ন হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন যান্ত্রিক শব্দ আর নাগরিক কোলাহল নিবিষ্ট চিত্তের মানুষকে অতিষ্ঠ করিয়া তোলে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার বিমানবন্দর এলাকাকে হর্নমুক্ত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করিয়াছে। এই ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক স্লোগান-সংবলিত ব্যানার, বিলবোর্ড ইত্যাদি স্থাপন; লিফলেট বিতরণ, আইন অমান্যকারীদের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ লইয়াছে সরকার। বহুদিন ধরিয়াই আমাদের দেশে শব্দদূষণের সমস্যা ক্রমবর্ধমান। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান নগরীতে শব্দদূষণের মাত্রা প্রায়শই সহনসীমা অতিক্রম করিয়া থাকে। ইহার নেপথ্যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং যান্ত্রিকায়ণ একটি বড় ভূমিকা পালন করিতেছে। যন্ত্রের শব্দ, নির্মাণকাজের আওয়াজ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের উচ্চ শব্দ ছাড়াও অযাচিত হর্ন বাজাইবার প্রবণতা শব্দদূষণের এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে চিহ্নিত হইয়াছে। ইহার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হইতেছে এবং পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হইতেছে।
শব্দদূষণের সর্বাধিক প্রকোপ দেখা যায় শহরের রাস্তাঘাটে। যানবাহনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণে এই সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করিতেছে। বিশেষত, যানবাহনের চালকেরা প্রায়শই প্রয়োজনের অতিরিক্ত হর্ন বাজাইবার অভ্যাসে অভ্যস্ত হইয়াছে। ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষার সময় কিংবা সামান্য যানজটেও চালকেরা অহেতুক হর্ন বাজান, যাহা আশপাশের মানুষের জন্য চরম অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে চালকেরা হর্নকে একপ্রকার অনিবার্য মাধ্যম মনে করিয়া প্রয়োগ করেন, অথচ যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যাটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাইতে পারে।প্রথমত, অযাচিত হর্ন বাজাইবার সমস্যাটি বিশেষত বিদ্যালয়, হাসপাতাল, কিংবা আবাসিক এলাকায় আরো বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলিতেছে। হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দ শিশুদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাইতেছে এবং রোগীদের স্বস্তি নষ্ট করিতেছে। এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় শব্দদূষণ মানুষের মানসিক চাপ বাড়াইয়া দেয়। দীর্ঘদিন উচ্চ শব্দে বসবাস করিবার ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়
এবং ইহা ক্রমান্বয়ে মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করিতে পারে। বিশেষ করিয়া, বয়স্ক ও শিশুরা এই শব্দদূষণের প্রতি অধিকতর সংবেদনশীল।
দ্বিতীয়ত, নিত্যদিনের নির্মাণকাজ, বিশেষত শহরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও ভবন নির্মাণের কার্যক্রমে ব্যবহৃত বড় বড় যন্ত্রপাতি মারাত্মক শব্দদূষণের কারণ হইতেছে।
তৃতীয়ত, শিল্পকারখানায় যন্ত্রপাতির অবিরত আওয়াজ মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের ক্ষতি করিতেছে। সর্বোপরি, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইক এবং সাউন্ড সিস্টেম উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টি করিতেছে, যাহা নিকটবর্তী মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করিতেছে।
শব্দদূষণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলিতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দে দীর্ঘদিন বসবাস করিবার ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাইতে পারে, যাহা পরবর্তীতে স্থায়ী বধিরতার কারণ হইতে পারে।
তদ্ব্যতীত, উচ্চশব্দে দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের ফলে মানুষের মস্তিষ্কে চাপ বৃদ্ধি পাইয়া মাথাব্যথা, অনিদ্রা, ক্লান্তি ও মানসিক উদ্বেগের সৃষ্টি। হয়। বিশেষ করিয়া, শিশু ও বয়স্ক মানুষের জন্য এই সমস্যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
উপরন্তু, শব্দদূষণের কারণে হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, এবং মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়া যাইতেছে। শুধু মানবস্বাস্থ্যের উপর নহে, পশুপাখির জীবনেও শব্দদূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়িতেছে। উচ্চশব্দের কারণে পশুপাখির প্রাকৃতিক বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে এবং তাহাদের জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হইতেছে। সুতরাং সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, শব্দদূষণ রোধের এই সকল উদ্যোগ ক্রমশ ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করিবে।