বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার যে রায় দিয়েছেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, তা এককথায় যুগান্তকারী। কেননা মনে করা হচ্ছে, এ রায় বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাব ও দলীয়করণমুক্ত করে স্বাধীন এবং নিরেপক্ষভাবে বিচারকাজ নিশ্চিত করতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখবে।
গত রোববার বিচারপতিদের অপসারণের বিধানসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পাশাপাশি বিচারপতিদের অপসারণ ও পদত্যাগের বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর করতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়। রোববার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ এ রায় দেন। অর্থাৎ রায়টির মধ্য দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আদেশ বহাল রইল এবং বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরে এলো। এখন থেকে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এ ছাড়া এই রায়ে বিচারপতিদের জন্য করা ৩৯ দফার আচরণবিধি এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব পর্যবেক্ষণ বহাল রয়েছে।
আমরা জানি, ’৭২-এর সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল জাতীয় সংসদের কাছে। ১৯৭৫ সালের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে সেই ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেওয়া হয়, যার প্রধান ছিলেন প্রধান বিচারপতি। এরপর উচ্চ আদালতের কোনো বিচারপতি যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাকে কীভাবে অপসারণ করা হবে—এ বিষয়ে ২০১৪ সালে আবার সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ সরকার। ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয়, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছর ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। একই বছর ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে রায় দেন। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন (রিভিউ) করে রাষ্ট্রপক্ষ। ধারাবাহিক আইনি প্রক্রিয়ার পর রোববার এ রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে রায় দেন আপিল বিভাগ।আমরা মনে করি, বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ভুক্ত করা হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এ প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিল না বিচার বিভাগের মতো সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় স্তম্ভও। মানুষ যেখানে ন্যায়বিচার পাবে, যেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, রাষ্ট্রের সেই বিভাগকে এ সময় সমালোচিত হতে দেখা যায়। আমাদের চাওয়া থাকবে, এখন থেকে বিচার বিভাগের স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে। দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতির প্রভাব থেকে বেরিয়ে পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে।