বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
জীবনে সফলতা লাভের চেষ্টা করে সবাই। সাফল্য পেলে মনটা খুশি হয়ে ওঠে। জীবনটা হয়ে উঠে আনন্দে টইটুম্বুর। অধিকাংশ মানুষ নিজে শুধু নয়, নিজের আশপাশে সফল মানুষকে দেখতে চায়। জীবনে জয়ী মানুষদের নামে নিজের সন্তানের নাম রাখেন। কারও নাম হয় জয়, আবার কারো নাম বিজয়! আচ্ছা, আপনি কি কি কখনো কোন মানুষের নাম ‘পরাজয়’ রাখতে শুনেছেন? শুনেন নাই। কারণ, বিফল মানুষকে আমাদের সমাজে হেয় চোখে দেখা হয়। কিন্তু, আমরা যদি উল্টোটা করতাম? এমন যদি হতো, নিজের পরাজয়টা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতাম? পরাজয়ী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাফল্য লাভে সাহায্য করতাম? কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা তা করি না।
আমাদের শুধু সফলতা লাভ করলেই চলবে না। বিফলতাও আমাদের জীবনে উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে। ভারতের প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম একবার বলেছিলেন, আমাদের শুধু সফলতা নিয়েই মেতে থাকলে চলবে না, কীভাবে ব্যর্থতার মোকাবিলা করতে হয় তা জানতে হবে। বিশেষ করে, আমাদের যখন নেতৃত্ব দিতে হয়, ব্যর্থতার মুখোমুখি হওয়াটা আমাদের শেখা উচিত। সমস্যা যেন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সমস্যা যেন আমাদের নেতৃত্ব দিতে না পারে, বরং, আমাদেরই কোনো সমস্যার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হতে হবে। সেই সমস্যার সমাধান বের করার দায়িত্ব নিতে হবে। সমস্যাকে পরাজিত করতে হবে। একজন সমাধানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সমস্যাগুলোর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে সফলতা ব্যাড় করে আনতে হবে। তবেই, সাফল্য লাভ করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানী এ,পি,জে, আবদুল কালাম ২৩ বছর বয়সে ভারতের বিমানবাহিনীতে একজন পাইলট হিসেবে যোগদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁকে নেওয়া হয় নাই। তাঁর মনে পাইলট হওয়ার ইচ্ছা রয়ে গিয়েছিল। অনেক দিন পরে, তিনি যখন ভারতের প্রেসিডেন্ট হলেন, তিনি বিমানবাহিনী প্রধানকে তাঁর পাইলট হওয়ার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেন। তারা তাঁকে ছয় মাস ট্রেনিং দিলে এ,পি,জে, আবদুল কালামের স্বপ্ন পূরণ হয়। তিনি তখন ভারতের এস, ইউ, ৩০ ফাইটার বিমান চালিয়ে নিজের স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন।
এখানে মনে রাখা উচিত, শিক্ষা সৃজনশীলতা এনে দেয়, সৃজনশীলতা আমাদের মাঝে চিন্তাশীল মস্তিষ্ক তৈরি করে,, একটি চিন্তাশীল মস্তিষ্ক যে কোন মানুষকে জ্ঞান লাভে সাহায্য করে, আর জ্ঞান লাভ করে সেই মানুষ মহান এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। এই সূত্র অনুসরণ করার ফলেই যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন সব মানুষের আবির্ভাব হয়েছে যারা নিজের সময়ের চলমান রীতি- নীতির খোল-নালচা পাল্টে সমাজে পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।
এখন প্রশ্ন রাখা যাক, জ্ঞান অর্থ কি? আসলে, জ্ঞান মাত্র তিনটি জিনিসে সমন্বয়ে গঠিত, সেগুলো হচ্ছে – সৃজনশীলতা, ভালো পথে চলা এবং সাহস। এই তিনটি জিনিস থাকলেই, যে কোনো জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। এই তিনটি গুণ একজন সত্যান্বেষী নাগরিক তৈরি করতে সাহায্য করে। একজন শিক্ষক এবং তিনি যেভাবে শিক্ষা দেন তা একটি শিক্ষার্থীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শিক্ষকের নিকট থেকে পাওয়া শিক্ষাই একজন ছাত্রের জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে যায়। জ্ঞানার্জন করা এই শিক্ষার্থী নিজের পরিবারে শান্তি বয়ে নিয়ে আসে। সেই পারিবারিক শান্তি একটি সুখী, সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সাহায্য করে। আর, একটি সুখী, সমৃদ্ধ দেশ সারা পৃথিবীতে শান্তি নিয়ে আসে।
প্রিয় পাঠক, নিজেকে প্রশ্ন করুন, একটি শান্তিময় বিশ্ব গড়তে তো সবার আগে একটি দায়িত্বশীল, ভালো মনের প্রয়োজন। একজন বিশুদ্ধ মনের মানুষ কীভাবে হওয়া যায়? প্রশ্নটা আসতেই পারে! মনে রাখতে হবে, যদি আপনার মাঝে বিশুদ্ধতা একবার গড়ে ফেলা যায়, আপনার একজন সত্যান্বেষী বিশ্ব নাগরিক হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না! আর, সেজন্যই হৃদয়ের মাঝে বিশুদ্ধতা আনা প্রয়োজন । হৃদয়ের বিশুদ্ধতা, একটি বিশুদ্ধ চরিত্র গড়তে সাহায্য করে। এই বিশুদ্ধ চরিত্র এমন হতে হবে যে, সে কোন কালেই সত্য কথা বলতে পিছপা হবে না। একজন বিশুদ্ধ মনের মানুষ সব সময়ে অন্য মানুষকে দিতে চায়। দুর্নীতি শুরু হয় তখনই যখন কেউ উল্টোটা করে, অর্থাৎ, দিতে চাওয়ার বদলে চেষ্টা করে। একজন বিশুদ্ধ মানুষ বলে – ‘আমি দিতে চাই’, আর, দুর্নীতিবাজ বলে – ‘আমাকে কি দেওয়া হবে’।
জ্ঞান লাভের সর্বশেষ স্তম্ভ হচ্ছে – সাহস। অন্য রকম ভাবে চিন্তা করার সাহস, আবিষ্কার করার সাহস, এমন পথ উদ্ভাবন করার সাহস যা আগে কখনো কেউ করতে পারে নাই, অজানা অসম্ভব কোন কিছুকে জানার সাহস, সমস্যাকে সমাধান করার সাহস। আর, এগুলো দেখাতে পারলে সাফল্য সামনে এসে ধরা দিবে।
স্বপ্ন মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়। আর চিন্তা কাজে পরিণত হয়। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়, যারা অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁরাই মানুষের সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে সম্ভব হয়েছেন। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সে বিজ্ঞান হোক কি স্বাস্থ্য কিংবা খেলাধুলা, বা আর্টস অথবা প্রযুক্তি, যে-সব মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যে চেষ্টা করে গিয়েছেন, তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় খোদাই করা। কল্পনার সীমাবদ্ধতাকে যারা ভেঙ্গে ফেলতে পেরেছেন, তাঁদের হাত ধরেই পৃথিবীতে পরিবর্তন এসেছে! ইবনে সিনা, আল-বেরুনী, নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা পাশের দেশের পদার্থ বিজ্ঞানী নোবেল জয়ী স্যার সি,ভি, রমন, সবাই-ই জীবনে চলার পথে ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু, সেই ধাক্কা তাঁদের নিজেদের লক্ষ্য থেকে এক চুল নড়াতে পারেনি। এইসব মহান ব্যক্তিত্ব কল্পনাকে হার মানিয়ে পৃথিবীতে পরিবর্তন এনেছেন।
আপনি যদি একজন আবিষ্কারক হয়ে থাকেন, কিংবা আপনি যদি একজন উদ্ভাবক হতে চান, আমি আপনাকে কি ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতেই হবে, এবারে তা বলবো। আবিষ্কার আর উদ্ভাবন একটি সৃজনশীল মস্তিষ্ক থেকে লুকিয়ে রাখা হয়। যে মস্তিষ্ক অনবরত কাজ করে যায়, সেই সাথে কল্পনা করতে থাকে, তার মাঝে সামনে কি ফলাফল আসবে সেটার এক ধারণা তৈরি হতে থাকে। আর, এভাবে কল্পনা আর অনবরত চেষ্টার ফলস্বরূপ পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডেরসকল শক্তি তার মাঝে লুকিয়ে থাকা আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনকে বাস্তব পৃথিবীতে বের করে নিয়ে আসে।
আগেই বলা হয়েছে, সবাই নিজের জীবনে সাফল্য লাভ করতে চায়। এখন, এই সাফল্য লাভ করতে কী করা উচিত? আসলে, সাফল্য লাভে আমাদের মাত্র চারটি জিনিস অনুসরণ করলেই হবে। প্রথমেই, আমাদের থাকতে হবে, তা হলো- মহান ও বড় লক্ষ্য। এরপরেই, সেই লক্ষ্যে পৌঁছুতে অনবরত জ্ঞান লাভ করতে হবে। তারপরে, সেই জ্ঞান লাভ করার জন্যে আমাদের কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। সর্বশেষে, নিজের লক্ষ্যের প্রতি অটুট থাকার চেষ্টা করে সাফল্য লাভের অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। তবেই লক্ষ্যে পৌঁছে জীবনে সাফল্য লাভ করা যাবে।
বিজ্ঞানী এ,পি,জে আবদুল কালাম অনেক ধরনের কাজ করেছেন। নিজের ক্যারিয়ারে কখনো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, আবার কখনো তাঁকে মহাকাশ বিজ্ঞানী, লেখক অথবা অধ্যাপনা করতে বিশ্ব দেখেছে। এতো সব কিছুর পরেও তিনি নিজেকে একজন ‘শিক্ষক’ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। তাঁকে এই নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হলে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে – ‘আমি যখন ১০ বছর বয়সী একজন কিশোর ছিলাম, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো। সেই সময়ে, একদিন, আমার পঞ্চম শ্রেণীর বিজ্ঞান শিক্ষক তখন শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলেন। আমি তার মাঝে জ্ঞানের আলো প্রতিফলিত হতে দেখেছিলাম। আমি তার মাঝে জীবনের বিশুদ্ধতার এক বিচ্ছুরণ দেখতে পাই। যেভাবে তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা আমার মনে এমন ভাবে গেঁথে যায় যে, আমার বাকি জীবনে কি করতে হবে তা ঠিক করে দিয়েছিলো। আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তার মতো একজন শিক্ষক হবো।‘ একজন শিক্ষকই পারেন তাঁর ছাত্রদের মাঝে নিজের স্বপ্নগুলোকে বুনে দিয়ে তাদেরকে সাফল্য লাভে সাহায্য করতে। ছাত্রদের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকেন। তাঁর ছাত্রদের মাঝে এমন অনেকেই হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে যারা তাঁকে অতিক্রম করে জীবনে তাঁর চেয়েও বড় সাফল্য লাভ করবে।
আমাদেরকে যে আকাশে পাখা মেলার স্বপ্ন দেখতে হবে! আমাদের মনে উড়তে পারার আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেতে হবে। আমরা সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই জন্ম হয়েছি। আমরা যখন সেই আত্মবিশ্বাস খুঁজে ব্যাড় করতে পারবো, তখনোই আমরা একদিন আকাশে পাখা মেলতে সক্ষম হবো। একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি, বিজ্ঞানী এ,পি,জে আব্দুল কালামের বাসায় একটি শত বছর বয়সী অর্জুন গাছ আছে। একবার আবদুল কালাম গাছকে জিজ্ঞাসা করে বসেছিলেন – ‘ওহে গাছ! ১০০ বছর ধরে তোমার বেঁচে থাকার অর্থ কি? তোমার জীবনের কি কোন মানে আছে?’ গাছ তাঁকে উত্তর দিয়েছিলো – ‘আমার যা যা আছে, তা বিলিয়ে দেওয়াই আমার জীবনের মিশন। আমি শত বছর ধরে তোমাদের ফুল দিয়ে গিয়েছি, আমার কাছ থেকেই তুমি মধু আহরণ করো। আমার দেহেই হাজারো পাখীর জন্ম হয়। আর, আমি তোমার মতো তরুণদের মনে শতবর্ষ বেঁচে থাকার আগ্রহ জন্ম দিয়ে সুখী হই।“ তবে, এই হোক আমাদের জীবনের লক্ষ্য।