বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

সদিচ্ছাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার…..

সদিচ্ছাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার পরম আরাধ্য মহীয়সী নারী ফজিলাতুননেছার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বন্ধু মোতাহার হোসেনকে গভীর বেদনা নিয়ে লিখেছিলেন—“আচ্ছা বন্ধু ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়।” সত্যিই তো এডিস মশা কত ফোঁটা রক্ত পান করলে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু হাজার হাজার ফোঁটা চোখের জল ঝরাতে পারে। যেখানে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়, সেখানে ১৮২টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ডেঙ্গুতে এখন ৩৫ হাজার ৩৬৫ জন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব বিস্তার লাভ করেছে শহর থেকে গ্রামস্তরে। মৌসুমির গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে সারা বছর। তাই ভয়াবহতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও সচেতনতার পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। দায়িত্বের পরিধি মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তর হয়ে ইউনিট থেকে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তাই সব অংশীজনই এর অন্তর্ভুক্ত। সবার সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব নিরূপণ, তার প্রজননস্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাদের নিজের। নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রবল সদিচ্ছার লালন করতে হবে। নিজেকে সচেতন নাগরিকের ভূমিকায় করতে হবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শুধুই সরকারি প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে নির্ভর করলেই চলবে না। সংযুক্ত করতে হবে নিজের নাগরিক দায়িত্ব ও মূল্য বোধের। একটি মাত্র ব্যবস্থাপনার মধ্যেই ঘুরপাক খেলে চলবে না। নিজের মধ্যে শুভবুদ্ধি ও ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার আনুপাতিক ভিত্তিতে সেবাপ্রার্থী ও সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই নিজের কর্ম করতে নিমগ্ন থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশে বিষয়ভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার পরিসর বেড়ে চলেছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং যোগ্য ব্যক্তিদের যথাযথ স্থানে নিয়োগ প্রদান দেশের মঙ্গলময় উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো ইকুয়াল ভিত্তিতে না দেখে ইকুইটি বা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে অবশ্যই দক্ষ ও নির্মোহ জনবল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেই আলোকে স্বাস্থ্য একটি অন্যতম মৌলিক চাহিদা। এই স্বাস্থ্য খাতে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তির সংখ্যা ও দক্ষতা পূরণ এবং নিশ্চিত করা জরুরি। এই ধরুন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ধরনের জনবল প্রয়োজন। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেমন প্রয়োজন মশক নিধনকর্মী, বিশেষজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ, দক্ষ প্রশাসক ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবর্গ। স্পষ্ট করলে এভাবে বলতে হয়, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নির্বিঘ্নে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট জনবলের সংশ্লিষ্টতা সমন্বয়ের সঙ্গে অতীব জরুরি। তাই দক্ষ জনবলের সংখ্যা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ইউনিটের সংশ্লিষ্টতায় মশক নিধনকর্মীর সমন্বয় জরুরি। একইভাবে প্রান্তিক এরিয়ায় ফারমার্স ফিল্ড স্কুল বা এফএফএসের সমন্বয়কারী কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা জরুরি। একই রূপে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার সঙ্গে সাধারণ জনসাধারণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত জরুরি। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস এবং সবুজ ও প্রশান্তিময় পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ডেঙ্গু দমনে পূর্বশর্ত। আমাদের মাথায় ভর করে বসে আছে শুধু কীটনাশক প্রয়োগেই মশা ধ্বংস করা যায়। আর এ দায়িত্ব শুধু সিটি করপোরেশনের। এই ভুল চিন্তাভাবনার কারণে ডেঙ্গু আজ দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। কেড়ে নিচ্ছে অতিমূল্যবান মানুষের জীবন। সময় এসেছে সংশোধনের। সময় এসেছে সচেতনতায় সম্পৃক্ত হয়ে সময়ের বিবর্তনে প্রগতিশীলতার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতকে সমন্বিত করার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি ইউনিটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক এন্টোমলজিস্ট এবং এন্টোম-টেকনোলজিস্টের নিয়োগ ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা। এক তথ্যমতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিটি করপোরেশন, সিডিসি, বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তর, সিভিল সার্জন অফিস প্রভৃতিতে সব মিলিয়ে ৯৪টি কীটতত্ত্ববিদ ও এন্টোম-টেকনোলজিস্টের পদ থাকলেও মাত্র ৪৭টি পদ পূরণ আছে। একে তো উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো পদ নেই। তারপরও ওপরের লেয়ারগুলোর পদে চরম স্বল্পতা আছে। তার মধ্যে ৫০ শতাংশ অপূর্ণ। এমন জনবল স্বল্পতা আর বিশেষজ্ঞদের অভাবে কীভাবে চলতে পারে অতিগুরুত্বপূর্ণ এ স্বাস্থ্য খাতের জনস্বাস্থ্যর এই অংশ। এত কিছুর ওপর গবেষণা এবং ফান্ডের অপ্রতুলতা লেগেই আছে। যন্ত্রপাতি আর প্রশিক্ষিত কর্মীর চরম স্বল্পতা। জনস্বাস্থ্য একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি খাত হওয়ার পরিবেশ ও পুষ্টির নিবিড়তা সমানভাবে গুরুত্বের দাবিদার। পরিবেশ যতক্ষণ পরিচ্ছন্ন না হবে মশা এবং মশাবাহিত রোগের বিস্তার কখনোই থামানো সম্ভব নয়। মশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। মশার শরীরের প্রতিরোধী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে বাহিত ভাইরাসেরও মিউটেশন হয়, যা আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। যার আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার সেরোটাইপের আক্রমণের তীব্রতারও তারতম্য ঘটে পরিবর্তিত পরিবেশে। পরিবেশ ও পুষ্টির যথার্থতা নিরূপণ করে তার কাঙ্ক্ষিত প্রয়োগ অবশ্যই সদিচ্ছা আর জবাবদিহি ছাড়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভেক্টর নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত জনবলের সদিচ্ছা, জবাবদিহি ও স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেম ছাড়া কখনোই বাহক নির্মূল সম্ভব নয়। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে দেশপ্রেম আর সচ্ছতার জবাবদিহি নিশ্চিত হলেই শুধু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। যতটুকুই অবকাঠামো আর মানবসম্পদ আছে তার সঠিক ব্যবস্থাপনাও যদি সম্ভব হয় তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপমৃত্যু দেখতে হবে না। নিজেকে যদি জিজ্ঞাসা করি এডিস মশা দমনে আমার অবদান কতটুকু। আর মশার প্রজননস্থল বাড়াতে আমার অবদান কতটুকু। মশা যে স্থানে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা উৎপাদন করে সেই ক্ষেত্রগুলো প্রতিদিন মানুষের কার্যক্রমের কারণে কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার অ্যাসেসমেন্ট নিজের মধ্যেই রয়েছে। আমরা খুব ভালো করেই জানি ভাইরাস আক্রান্ত মশা দেশের যত্রতত্র ছড়িছে পড়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সর্বোচ্চ। এখানে রোগীর প্রকৃত ঠিকানা অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি প্রতিটি ভর্তিকৃত রোগীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানে সত্যিকার ঠিকানা পাওয়া যায় তখন অবশ্যই ওই নির্দিষ্ট বাড়ির চারপাশে কমপক্ষে ২০০টি বাড়ি পর্যন্ত ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে। আর এই সঠিকভাবে ক্রাশ-প্রোগ্রাম চালানোর অভাবেই দ্রুতগতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। এখন প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ টিমের আওতায় ওয়ার্ড পর্যন্ত লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে ডেঙ্গু অধ্যুষিত এলাকাগুলো সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারিতে রাখা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি শক্তিশালী কর্মী বাহিনীর সঙ্গে বিশেষজ্ঞ টিম ২৪ ঘণ্টা রেডি রাখা। কোনো ধরনের অবহেলা নয়। প্রতিটি প্রাণ মহামূল্যবান। একই সঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে নিবিড় ডেঙ্গু কর্নার চালু করে ২৪ ঘণ্টা প্রশিক্ষিত ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞের উপস্থিতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এফএফএসে কৃষকদের আইপিএম যেভাবে প্রয়োগ করার প্রশিক্ষণ হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। একইভাবে একই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পৃক্ত করে গৃহায়ন ও গণপূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এর সঙ্গে সম্যক জ্ঞানে ঋদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। নির্মোহভাবে মনে রাখা দরকার দেশটা আমাদের সবার। এর প্রতিটি অঙ্গ সচল রাখতে হলে প্রয়োজন সবাইকে রোগমুক্ত সুস্থ থাকা। এই দৃঢ় প্রত্যয় সবাইকে ব্যক্ত করতে হবে। ভাইরাস যেমন চোখে দেখা যায় না; তেমনি মশা কখন এবং কোথায় কামড়াবে তাও নিশ্চিত করা যায় না। তাই মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করাই উত্তম সমাধান, যা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করার মূল সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। যে মানুষগুলো অসাবধানতাবশত মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করেছে তাদেরই ওই প্রজনন ধ্বংস করার কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। একজন ড্রাইভার যখন গ্যারাজে গাড়ি ধৌত করে তখন তাকেই ওই জমে থাকা পানি অপসারণে সংযুক্ত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। গাড়ির নষ্ট টায়ার ওয়ার্কশপে কর্মরত ব্যক্তিকেই পরিষ্কার করতে হবে। যারা ময়লা পরিষ্কার করে ডাম্পিং করেন, তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো প্রকার ওয়েট কনটেইনার খোলা স্থানে পড়ে না থাকে। এমনকি ডাম্পিং স্টেশনে কোনো খোলা ওয়েট কনটেইনার থাকতে পারবে না।ফিরে আসছি মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের শুরুর লাইনে আর এক ফোঁটাও রক্ত যেন মশা খেতে না পারে। ডেঙ্গু যেন আর এক ফোঁটা পানিও যেন আমাদের ঝরাতে না পারে। সে লক্ষ্যেই সবার মধ্যে যে সচেতনতার ভালো মানুষটি লুকিয়ে আছে, তাকে শানিত করে নিজেকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে এসে নিজেকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করে আসুন এই ভয়ানক ঘাতক ব্যাধি ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০