মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

বাগমারার ‘দুষ্ট জমিদার’ সাবেক এমপি এনামুল

বাগমারার ‘দুষ্ট জমিদার’ সাবেক এমপি এনামুল

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক সংসদ সসদ্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের আচরণ ছিল আগের আমলের দুষ্ট জমিদারদের মতো। সুযোগ পেলেই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দখলে নিতেন অন্যের জমি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এলাকায় শত শত বিঘা জমি দখলের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে এনামুল হক হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। ভূমি দখল, বিভিন্ন পুকুর খনন প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি চাকরি দেওয়া, তাহেরপুর পৌরসভার যে কোনো বরাদ্দ হলেই তাকে নির্দিষ্ট হারে কমিশন দিতে হতো। বাগমারা উপজেলার বরাদ্দকৃত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাজেট থেকেও ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন তিনি।

২০১৪ সালে বাগমারা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সূত্র মতে, এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হক দুদকে মাত্র ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই তাদের সম্পদ ছিল অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার। এনামুলকে ওই সময় দুদক কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার প্রভাবে পার পেয়ে যান এনামুল। তখন দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এনামুল হকের মালিকানাধীন ও অংশীদারত্বে থাকা ১৪টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করা হয়। এ ছাড়া এনা প্রপার্টিজ, সালেহা-ইমারত কোল্ড স্টোরেজ, এনা-ডুঙ্গা লিজিং, নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড, এনা ইন্টারন্যাশনাল, এনা কারস, এনা এনার্জি লিমিটেডসহ অন্য প্রতিষ্ঠানে তার শেয়ার বা মালিকানার বিষয়টিও সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি।

সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নেও এনামুল হক সম্পদের তথ্য গোপন করেছিলেন। তার নামে ১৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছিল সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে দুদক অনুসন্ধান চালিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ), রাজশাহী সিটি করপোরেশন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পিপলস লিজিং কোম্পানি, আল-ফালাহ ব্যাংক, ব্র্যাক-ডেল্টা হাউজিং, রাজশাহী জেলা রেজিস্ট্রার, বাগমারা, নওগাঁ, নবাবগঞ্জ, নাটোর সাব-রেজিস্ট্রার, ঢাকার ১৩টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হকের নামে অর্থ ও স্থাবর সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে আদালতের জব্দ করা সম্পত্তি দখলের অভিযোগও রয়েছে এনামুল হকের বিরুদ্ধে। জমির মালিক মেট্রো হোমস লিমিটেডের মধ্যে মামলা জটিলতার সুযোগে ওই জমি দখল করেন এনামুল। মেট্রো হোমসের তত্ত্বাবধানে নির্মীয়মাণ একটি বাণিজ্যিক ভবন ও জায়গা আদালত কর্তৃক জব্দ ও স্থিতাবস্থার আদেশ থাকার পরও এনামুল হকের এনা গ্রুপ ওই জায়গায় সাইনবোর্ড টানিয়ে দখল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর থেকে গ্রেপ্তার হন এনামুল। র্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি এনামুল ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তিনি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনামুল হককে ঘিরে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঋণ পরিশোধ না করা, ভূমি দখল, অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্যসহ প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের মতো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসতে শুরু করে। অভিযোগ উঠেছে, হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিও তিনি। এ অবস্থায় তার সম্পদসহ দুর্নীতি-অনিয়মের খোঁজে নামে দুদক।

বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তৎকালীন এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ও তার ভাই মাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল হক লেদা প্রকৃত জমির মালিকদের মামলার ভয় দেখিয়ে হামলা চালিয়ে চার ফসলি এসব জমি হাতিয়ে নেন। জমির মালিকদের মূল্যও পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি জমিতে থাকা ফসল তুলতে গেলেও তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।

দখল হওয়া প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির মালিক আশিক আলী প্রামাণিক বলেন, ‘এনামুল যখন জমি দখল করতে শুরু করল, আমরা সবাই মামলা করি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জমির দলিলে দেখানো হয়েছে ডোবা। এখন পর্যন্ত কোনো টাকা দেয়নি। উল্টো বলেছে, আমরা নাকি জমি দান করে দিয়েছি। পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড সবাই তার কথায় উঠত-বসত।’

আশিকের মতো আরও ১৫ জন ভুক্তভোগী এনামুলের অবৈধ দখলের শিকার হয়েছেন। ভবানীগঞ্জ বাজার এলাকার সত্তরোর্ধ্ব সামায়ন আলীর দাবি, তার কোটি টাকা মূল্যের জমিও এমপি এনামুল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখলে নিয়েছে। সম্প্রতি সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছেন ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক। সামায়ন আলী বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেকের জমি দখল করে নিয়েছেন এমপি ও তার পছন্দের মেয়র মালেক। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়ে লাভ হয়নি। ওই সময় পুলিশ ও প্রশাসন সবাই তার লোক ছিল।’

এলাকাবাসীর দাবি, তিনবার এমপি থাকায় এনামুল এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই হেলমেট বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হতো। সেইসঙ্গে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা হতো। এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তিনি ভবানীগঞ্জে নিজে একটি বহুতল মার্কেট গড়েছেন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট। এই মার্কেট নির্মাণের আগেও সেখানে ৬০-৭০টি দোকান ছিল। সেগুলো প্রভাব খাটিয়ে ভাঙচুর করে তাদের বিতাড়িত করেন এনামুল ও তার বাহিনী।

ভুক্তভোগী জুলেখা খাতুন বলেন, ‘আমাদের ওখানে দুটি দোকান ছিল। আমাদের দাদার আমলে বানানো সেসব দোকান। দোকান দুটি থেকে ১০টি পরিবারের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু এনামুল নিজে মার্কেট করতে গিয়ে ওইসব দোকান ভেঙে ফেলেছে। তার মার্কেটের সামনের রাস্তা প্রশস্ত করেছে।’

শুধু জুলেখা নন, ২০১২ সালে জিল্লুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, এন্তাজুল ইসলাম, মৌসুমী, রমজান আলী মাস্টার, মতিউর রহমান মাস্টার. ডা. এবাদুর রহমান, আব্দুর রহমান, আব্দুল মজিদ, মকবুল হোসেন মেকার, কাতিবুল্লাহ, আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রায় ৫০ জন ভুক্তভোগীকে উচ্ছেদ করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট গড়ে তোলেন।

এমপি থাকাকালে এনামুল স্থানীয় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ পরিচালনা কমিটি করে দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। এ কাজে তার সহযোগী ছিল সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসহ পরিচালনা কমিটি। ভবানীগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ও একাধিক শিক্ষক জানান, এনামুল এমপি থাকার সময় ভাইস-প্রিন্সিপালের মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন। এই এক কলেজ থেকেই প্রায় দেড় কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য হয়েছে তার তত্ত্বাবধানে। শিক্ষকপ্রতি নেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। অনুদানের টাকা এলেও আত্মসাৎ করতেন তিনি। এমন ঘটনা ঘটেছে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

আক্তার হোসেন নামে বাগমারার এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, ‘এনামুলের বিরুদ্ধে বাগমারায় ইটের ভাটা ও জমি দখলের অভিযোগের শেষ নেই। সাবেক এই এমপি নৈশপ্রহরী, স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, তদবির-বাণিজ্য, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যেও পটু ছিলেন।’

দুর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক এমপি এনামুল।’ শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সাবেক এমপি এনামুল তার অধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মাসের পর মাস আটকে রেখেছেন।

সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বর্তমানে কারগারে থাকায় তার অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১