বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
শুধু বাজার তদারকি কিংবা চাঁদাবাজি কমানোর মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম কমানো যাবে না। দীর্ঘ মেয়াদে দাম কমাতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সরকারের নীতির স্থিতিশীলতা থাকতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে নীতির সংশোধন করতে হবে।গতকাল শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম আয়োজিত এক সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি: সংকট সমাধানের আশু উপায়’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভুল নীতির কারণে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি কমাতে এসব নীতি সংশোধন করতে হবে।সংলাপ সঞ্চালনা করেন ভয়েস ফর রিফর্ম প্ল্যাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর। মূল আলোচক ছিলেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিরডাপ) পরিচালক (গবেষণা) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান ও চালডালের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ওয়াসিম আলীম।ফাহিম মাশরুর বলেন, দুই বছরের বেশি সময় দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর আমরা আশা করেছিলাম জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমবে; কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।সিরডাপ পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, আমি তা ঠিক মনে করি না। কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় উচ্চ দাম ধরে রাখতে পারে না, বরং অতীতে নেওয়া বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। আগের সরকারের প্রবৃদ্ধি দেখানোর নীতির নেতিবাচক ফল হচ্ছে বর্তমান মূল্যস্ফীতি।তিনি বলেন, সরবরাহ পরিস্থিতি এবং চাঁদাবাজির মতো খরচের কারণে জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়ে, কিন্তু তা সাময়িক। উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সে জন্য দীর্ঘ মেয়াদে পণ্যের দাম কমাতে হলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।চালডালের সিইও ওয়াসিম আলীম বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়ন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আড়াই বছরের মধ্যে ১ ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়েছে। এটি মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। বিগত সময়ে অবাধে টাকা ছাপানো ও টাকা পাচারের কারণেও দ্রব্যমূল্যে প্রভাব পড়েছে।ওয়াসিম আলীম বলেন, এখন দাম কমাতে হলে পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্কও কমাতে হবে। বিশেষ করে দেশে প্রোটিন খাওয়া বেড়েছে; এখানে যত আমদানি শুল্ক আছে, তা তুলে নেওয়া উচিত। এ ছাড়া শুল্ক কমালে চাল, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল—এ ধরনের পণ্যের দামও কমা উচিত।অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, ২০১৪-১৯ সময়ে দেশে করোনা ছিল না, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়নি, মুদ্রার বিনিময় হার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। তখনো দেশে প্রায় ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। অথচ একই সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম ছিল। তখন অর্থনীতি ঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। পরে বৈশ্বিক নানান চ্যালেঞ্জের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে এ পর্যায়ে উঠেছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সামষ্টিক নীতির মাধ্যমেই করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাময়িকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও তা মেনে নিতে হবে।উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বাজার তদারকিতে জোর দেন। তারা বলেন, দেড় মাসের মধ্যে চালের দাম ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে; এর কারণ ধানের দরবৃদ্ধি। ধানের বাজার তদারক করা হয় না। এ ছাড়া পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে আনারও পরামর্শ দেন তারা।সিআই লজিস্টিকসের (স্বপ্ন) হেড অব বিজনেস (কমোডিটি) নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, পচনশীল পণ্যের জন্য আমাদের সরবরাহ খাত উপযোগী নয়। অপচয় কমানো গেলে পণ্যের দাম অনেকটা কমবে।শপআপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মোকামের চিফ অব স্টাফ জিয়াউল হক ভূঁইয়া বলেন, দেশে পণ্য উৎপাদন ও চাহিদার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে জন্য আমরা পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত পরবর্তী এক-দুই বছরে পেঁয়াজের মতো পণ্য রপ্তানি করবে কি না, সেটা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়।