বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
কৃষিতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া আর মাঠপর্যায়ে পৌঁছানো কৃষির আধুনিক উপকরণে নেত্রকোনায় বেড়ে চলেছে ধানের উৎপাদন। একই জমিতে গত দেড় দশকে প্রতি ১০ শতাংশে ফলন বেড়েছে এক থেকে তিন মণ।কৃষি অধিদপ্তর বলছে, পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন জাতের ধান আবিষ্কার, কৃষিতে আধুনিকায়ন, পর্যাপ্ত সার-বীজ সরবরাহ, কৃষক পর্যায়ে সরকারি প্রণোদনা, কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানসহ সরকারি নানা উদ্যোগের কারণেই কৃষিতে এই পরিবর্তন এসেছে।২০০৯ সালে নেত্রকোনা জেলায় এক লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর বোরো আবাদ করা হয়। যেখানে এক লাখ ৩৮ হাজার ৯৫৫ হেক্টরে উফশী এবং ৩৬ হাজার হেক্টর হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করা হয়েছিল। উফশী জাতে প্রতি ১০ শতাংশে গড়ে ফলন সাড়ে পাঁচ মণ ও হাইব্রিড জাতে হয় গড়ে সাত মণ। তখন জেলায় ধান উৎপাদন হতো সাড়ে ১০ লাখ টন।হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধান উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে এর বিস্তারে একই জমিতে বাড়তে থাকে ফলন। ১৫ বছর পর চলতি বোরো মৌসুমে এক লাখ ৮৫ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২ লাখ টনে, যা আগের থেকে প্রায় দুই লাখ টন বেশি।নতুন জাতের হাইব্রিড, উফশী ধান আবাদ, প্রয়োজনীয় বীজ এবং সার ও সেচ দিতে পারায় একই জমিতে এখন তারা বাড়তি ফলন পাচ্ছেন।কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষির আধুনিকায়ন, সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতার কারণেই ফসল উৎপাদনে সুদিন ফিরেছে।জেলা সদরের গজিনপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আলিম বলেন, আগে চার কাঠা (৪০ শতাংশ) জমিতে ২০ মণ ধান পেতাম। এখন এই একই জায়গায় আমি ৩০ মণ ধান পাই। নতুন জাত আসায় আমাদের ফসলের উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি সার পাচ্ছি কোনো ঝামেলা ছাড়াই। প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক দিতে পারতেছি। এজন্য ফসলের উৎপাদন আগের থেকে বেড়েছে।সত্তরোর্ধ্ব রমিজ মিয়া মুখে হাসি নিয়ে বলছিলেন, ‘এখন সার-বীজ সবকিছুই সহজে পাই। আগে জমিতে দেয়ার জন্য সারই পেতাম না। কারেন্ট থাকত না, কীটনাশক দিতে পারতাম না। এখন সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সার পাই। আগে কারেন্ট থাকত না, সেচ দিতে পারতাম না। এখন কারেন্ট মাঝে মাঝে গেলেও সেচ দেয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। ভর্তুকি দিয়ে মেশিন দিচ্ছে কৃষকদের। নতুন ভালো জাতের বীজ পেয়েছি, যেগুলো দিয়ে আমরা ধান বেশি উৎপাদন করতে পারছি। আগে দু-তিন মণ ধান পেতাম, এখন পাঁচ-ছয় মণ ধান পাই। কিছু জমিতে আট মণ পর্যন্ত ধান পাচ্ছি আমরা। জমির উঁচু-নিচু ভেদে একটু কম-বেশি হয়।’একই গ্রামের আরেক কৃষক লাল মিয়া বলেন, আগে আমরা লাল হাইজং, সাদা হাইজং, বোরো ধান প্রতি কাঠায় (১০ শতাংশ) দুই মণ পেতাম। অন্যগুলো চার মণের মতো পেতাম। এখন যে নতুন ধানের জাত আসছে, এগুলো চাষ করে আমরা লাভবান। যেমন, মিতালী-৪ জাতের ধানে ৬-৭ মণ ধান পাচ্ছি। ব্রি ধান-৫৮ যে জাত আছে, ওটাও পাঁচ-ছয় মণ পাচ্ছি। এখন আমরা নতুন জাতের ধান চাষ করে অনেকটাই লাভবান হচ্ছি।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান জানিয়েছেন, বিগত দেড় দশকে আমাদের ধানের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য উচ্চ ফলনশীল যে জাতগুলো রয়েছে, সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বিস্তারসহ হাইব্রিড জাতের বিস্তার ঘটিয়েছি। নতুন যে জাতগুলো আছে, এগুলোর উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকরা সেগুলো গ্রহণ করছেন। আমাদের নতুন জাতগুলো প্রচুর কোয়ালিটিসম্পন্ন। সে হিসেবে আমাদের ধানের ফলন ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা আশা করি।পাশাপাশি কৃষি প্রদর্শনী প্লট, কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা ও সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে কাজ করাসহ কৃষকেরা উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদে ঝুঁকেছেন বলেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা। নেত্রকোনায় এ বছর এসএল-৮এইচ, হীরা-২, সিনজেনটা-১২০৮, ১২০৫, মিতালী-৪সহ ৫৫টি জাত হাইব্রিডে ও বঙ্গবন্ধু-১০০, ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৯৬, ব্রি-২৯সহ অন্তত ১৫টি জাতের উফশী ধান আবাদ হয়। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে হাইব্রিড, জিংকসমৃদ্ধ ও স্বল্প জীবনকালের জাতের ধান বেশি আবাদ হয়েছে।