বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
কিছু দিন আগে দেশের প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন দৈনিকে স্বাস্থ্যসেবার কিছু বিবরণী বেরিয়েছিল, যা রীতিমতো হতাশাজনক। এসবের বরাতে জানা যায়, চিকিৎসকের ওপর আস্থার সঙ্কট প্রকট। রোগীদের মাত্র ৩৩ শতাংশ চিকিৎসকের ওপর আস্থাবান। চিকিৎসকের পেশাগত ও নৈতিক দুর্বলতা চিকিৎসা ও রোগীর সন্তুষ্টির অন্তরায়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৪৫ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। অনেক মেডিক্যাল কলেজে নেই হাসপাতাল। স্থানীয় জেলা হাসপাতালে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয় শিক্ষার্থীদের। চাহিদার মাত্র ২৮ শতাংশ পদে রয়েছে নার্স। ওষুধ ব্যয়ের বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ওষুধে ব্যয়ের পরিমাণ ৪৪ শতাংশের বেশি, যা আশপাশের দেশের প্রায় দ্বিগুণ। মানহীন, ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে বাজার সয়লাব। অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। শিশু মৃত্যুহার ৩৩ প্রতি হাজারে। দেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে, চিকিৎসাসেবা অন্যতম মৌলিক অধিকার; যা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর দায়িত্ব সরকারের।
স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো মৌলিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার মিশন সামনে রেখে দিন দিন বাড়ানো হয়েছে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা, যা স্বাধীনতাপূর্ব সাতটি থেকে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ১১৮টিতে। এসব মেডিক্যাল কলেজে নেই কোনো স্থাপনা, নেই শিক্ষার পরিবেশ, নেই শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য সেই শ্রেণিকক্ষ, নেই গ্রন্থাগার। হাতে-কলমে শেখার নেই ল্যাবরেটরি। নেই রোগী। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দলীয়করণ আরো সুসংহত করতে তৈরি হয়েছে চারটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকের সমস্যা রয়েছে, সেখানে চারটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে চলবে তা সহজে অনুমেয়। এ দেশে মাথাপ্রতি চিকিৎসা বরাদ্দ ৫৮ ডলার, যার বেশির ভাগ খরচ হয়ে যায় জনশক্তির বেতন, বোনাস এবং নতুন নতুন স্থাপনা তৈরির পেছনে, সেখানে স্বাস্থ্যসেবার প্রান্তিক অবস্থাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার মৌলিক সমস্যার প্রথমে রয়েছে মাথাপিছু ব্যয় বরাদ্দ, যা দিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে একবেলা খাবারও জুটবে না। এ ধরনের ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে আর যা-ই হোক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়া সম্ভব নয়। সমস্যার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে- রোগী, চিকিৎসক এবং সেবক-সেবিকার আনুপাতিক হার, যা বিশ্বমানের অনেক নিচে। ফলে চিকিৎসদের অনেক বেশি চাপ সহ্য করতে হয়, সেবক-সেবিকাদের পড়তে হয় মানসিক চাপে। একজন চিকিৎসককে গড়ে ১০০ রোগী দেখতে হলে মানসম্মত চিকিৎসা দেয়া কোনোক্রমে সম্ভব নয়, এটা পাগলেও বোঝে। তৃতীয় সমস্যা চিকিৎসা ব্যয়। এটা আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে অনেক বেশি। এ জন্য রোগীরা বিদেশমুখী। মানহীন ভেজাল মেয়াদোত্তীর্ণ অপ্রয়োজনীয় ওষুধের বাজার দেখভালের দায়িত্ব যাদের, তারা প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে কার্যক্ষম নন। লাইসেন্সবিহীন এবং শিক্ষিত ফার্মাসিস্টবিহীন ওষুধের লাগাম ছাড়া দোকান জনস্বাস্থ্যের প্রতি বিরাট একটি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন জনস্বার্থে। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং সহযোগী জনশক্তির নিরাপত্তার ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে।
১১৮টি মেডিক্যাল কলেজ, চারটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র, ৪৮৩টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, নার্সিং স্কুল এবং কলেজ- সবমিলিয়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞের। দেখাশোনা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পক্ষে স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং লক্ষাধিক ডাক্তার, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা এককভাবে পরিচালনা খুব দুরূহ। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা দুটোর পৃথকায়ন অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীয়করণ এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া দেশের প্রান্ত-প্রত্যন্তে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ক্লিনিক যেন রোগীর জন্য মৃত্যুফাঁদ। এসব ক্লিনিকে যথাযথ মান ছাড়া রোগীর চিকিৎসা ও অপারেশন করা হচ্ছে। ফলে প্রায় ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিকেলবেলা চেম্বার চালু করার কথা ভাবা যেতে পারে। এতে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রোগীকে পরামর্শ দিতে পারবেন। অন্য দিকে পারিশ্রমিকের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ নামে প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হবে। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার একটি নির্দিষ্ট মান তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি বিরাট অংশ সরকারি আনুক‚ল্যে প্রেষণের নামে বছরের পর বছর রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে আছেন। এতে রাজধানীর বাইরে প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার ব্যাঘাত ঘটছে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন এবং অনুসরণ করা প্রয়োজন। কয়েক বছর আগে দলবাজির সুযোগ নিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে হাজারখানেক চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে। এতে চরমভাবে মেধার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। পিএসসিকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক পদায়ন স্বাস্থ্যসেবার সঠিক মান বজায় রাখতে পারেনি। দেশের স্বার্থে এ ধরনের নিয়োগ চিরতরে বন্ধ হওয়া দরকার। স্বাস্থ্যসেবা কাঙ্খিত মানে উন্নীতকরণ, চিকিৎসকদের সঠিক এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যসেবার প্রতি জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে।
সঠিক মানের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে আরেকটি পরিমাপক। স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন উপকরণের আকাশচুম্বী মূল্য যেকোনোভাবে হোক না কেন, জনগণের আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট পরামর্শ ফি এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীর সেবা প্রদান নিশ্চিতের বিকল্প নেই। অবিলম্বে রাজনৈতিক সুবিধায় প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজগুলো যথাসম্ভব একীভূত করার কাজ শুরু করা দরকার। চিকিৎসা, শিক্ষা এবং পরিষেবা পৃথকীকরণ সময়ের দাবি। বিএমডিসি, বিএমআরসি জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধার ভিত্তিতে পদায়ন অত্যন্ত জরুরি। নইলে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে থাকবে।
বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিবর্তন ও মানোন্নয়নে একটি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ কমিটি তৈরি করে তাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শক দিতে। কমিটির সুপারিশমালা স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, এ প্রত্যাশা জাতির।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com