শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
◾ এম আবদুল্লাহ ◾
আবার আলোচনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অবশ্য এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। নিয়মিত বিরতিতে জামায়াত আলোচনায় আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক আলোচনার রসদ হয় ইসলামপন্থী বৃহত্তম দলটি। এবার এমন একটি সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে যখন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ৪/৫ মাস বাকী।
শনিবার (১০ জুন) রাজধানীতে একটি সমাবেশ করে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে জামায়াত। আলোচনা হওয়ারই কথা। এক দশক পর এ ধরনের সমাবেশ বলে কথা! প্রায় পনের বছর আগে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে দুর্যোগের মুখে পড়ে জামায়াত। ২০১০ সালের জুনে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, নায়েবে আমীর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাসহ একে একে শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর থেকে জামায়াতকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছিল না পুলিশ। দলটির কেন্দ্রীয় ও মহানগর কার্যালয়সহ সরাদেশের দলীয় অফিস বন্ধ আছে এ দীর্ঘ সময় ধরে।
২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লার মামলার রায় হওয়ার আগের দিন ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছিল দলটি। এরপর দশ বছর ধরে জামায়াত সমাবেশের কোনো অনুমতি পায়নি। তবে অনুমতি ছাড়াই জামায়াত ঘরোয়া সভা-সমাবেশ যেমন করেছে, তেমনি রাজপথে ঝটিকা মিছিল করে নিজেদের শক্তির জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন ইস্যুতে। যদিও এসব ঝটিকা মিছিল-সমাবেশ নিজস্ব মুখপত্র ছাড়া মূলধারার অন্য কোন গণমাধ্যমে তেমন একটা স্থান পায়নি।
শনিবারের সমাবেশ ঘিরে জামায়াত নেতাকর্মীদের বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস, নেতাদের মঞ্চকাঁপানো আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য, সমাবেশের লাইভ প্রচার সোশ্যাল মিডয়ায় লাখ লাখ ভিউ, মূলধারার গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল, টিভি টকশোতে প্রথম বারের মতো জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের অংশগ্রহণ, দায়িত্বরত পুলিশকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো, নেতাদের কন্ঠে পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা, নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ ইত্যাকার বিষয় রাজনীতির অঙ্গনকে এক ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে।
হঠাৎ জামায়াতের ব্যাপারে সরকারের এই সহনশীল আচরণের তিনটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করার আগে একটু পেছন ফিরে দেখা জরুরী। সরকার ও জামায়াতের মধ্যকার সম্পর্কের নানা সমীকরণ ও জামায়াতে হঠাৎ মাঠে ফেরা বিএনপি-জামায়াতের শীতল সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা জানতে নিবন্ধের শেষ পর্যন্ত চোখ বুলাতে হবে।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০০ শাসনকালে বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধ হয়। প্রথমে চার দলীয় জোট ও পরে তার পরিসর বেড়ে ২০ দলে উন্নীত হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিশাল বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বারের মত সরকারের পার্টানার হয় জামায়াত। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন শীর্ষ দুই নেতা। পরবর্তীতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার সম্পর্ক কখনও উষ্ণ আবার কখনও শীতল হলেও একেবারে ছিড় ধরেনি।
গত বছর থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে-এমন আলোচনা সামনে আসে। দূরত্বটা কখনও কখনও টানাপড়েনে রূপ নেওয়ার খবরও চাউর হয়। দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান এক সাংগঠনিক সভায় বিএনপি’র সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন এবং এককভাবে আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন। বিএনপি’র পক্ষ থেকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের অভিযোগ তুলেন জামায়াত আমীর। এছাড়া প্রহসনের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একে একে ফাঁসির মঞ্চে পাঠানো হলেও বিএনপি নেতৃত্ব কেন ন্যুনতম প্রতিক্রিয়া দেখাননি- সে ক্ষোভ দেখা গেছে জামায়াত ঘরানায়। যদিও বিএনপি নিজ দলের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলীমদের বিচার-ফাঁসির রায়েও নির্বিকার ছিল। অভ্যন্তরীণ ওই সভায় জামায়াত আমীরের বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে তখনও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা গুঞ্জরিত হয়। জাতীয় নির্বাচনের দু’বছর আগেই বিভিন্ন আসনে দলের প্রার্থী ঘোষণা করে সন্দেহের তীর-বিদ্ধ হতে হয়েছে দলটিকে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ-জামায়াত ও বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের রসায়ন বিচিত্র ও কৌতুহলোদ্দিপক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধীতার তকমা নিয়েও জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বার বার ক্ষমতার নিয়ামক হয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারের কাছে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতকে সঙ্গী হিসেবে প্রয়োজন হয়েছিল মক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্ট আওয়ামী লীগের। তখন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতে এক মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জামায়াতের তৎকালীন মহাসচিব মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছবি এখনও গুগল ইমেজে ভাসছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার কক্ষপথ থেকে বিএনপি’র ছিটকে পড়ার জন্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতকেও দায়ী করা হয়। মনে করা হয়, সে সময় কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মূলা নিয়ে আওয়ামী লীগের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে রসদ না যোগালে সেক্যুলার দলটি হয়তো ৫১ বছরেও ক্ষমতার মুখ দেখতো না।
তারও আগে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে জামায়াত। পরে অবশ্য ১৯৮৬ সালে এরশাদের ক্ষমতা রক্ষার বোঝাপড়ার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে প্রথম বারের মত ১০টি আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে স্থান করে নিয়েছিল আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বাধীন জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ। আবার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফালাফল বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই নির্বাচনে জামায়াতের আসন সরকার গঠনের নিয়ামক হয়ে পড়ে। ফলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই জামায়াতের কাছে সমর্থন প্রার্থনা করে। শেষ পর্যন্ত সরকারের পার্টনার না হয়ে কিংবা কোন প্রাপ্তি ছাড়াই বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় দলটি। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রথম সরকার গঠিত হয়।
সেসময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দুই দল জামায়াতের মুখোপেক্ষী হয়। বিএনপির প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের পক্ষেই ভোট দেন জামায়াতের এমপিরা। বিএনপি’র সেই সরকারের সময়ে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদল-শিবির রক্তক্ষয়ী আধিপত্যের লড়াই দুই মুরুব্বি দলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, তিক্ততা বাড়ায়। সংসদে জামায়াতের সমালোচনায় মুখর হন বিএনপি’র অনেক নেতা। অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ইস্যু এবং গণআদালত নামের নাটকে পরোক্ষ সায় বিএনপি-জামায়াত দুই দলকে ভিন্ন কক্ষপথে ঠেলে দেয়। তার জেরেই মূলতঃ তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আওয়ামী লীগ সঙ্গী হিসেবে পায় জামায়াতকে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশে যে কয়টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তার ফলাফল নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে জামায়াত ও বিএনপি’র ভোট এক হলে দুই দলই লাভবান হয়। বিপর্যয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। দেশের অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি আসন রয়েছে যেখানে জামায়াতের ১০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত ভোট রয়েছে। বিএনপির ভোটের সঙ্গে ১০ থেকে ৫০ হাজার ভোট যোগ হলে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত হয়। আবার ৫০ হাজারের অধিক জামায়াতের ভোট আছে এমন আসনে বিএনপি’র ভোট যুক্ত হলে জামায়াত প্রার্থী জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারেন। তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলে এমন চিত্র উঠে এসেছে। মূলত: এ হিসাবটিই জামায়াতকে নিয়ে দু’দলের ‘খেলা’র প্রধান সূত্র। আওয়ামী লীগ চায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যেন বিএনপি-জামায়াতের ভোট এক মার্কায় না পড়ে। তা পড়লে ২০০১ এর মতো আওয়ামী লীগের ভরাডুবি অনিবার্য।
অবশ্য এরই মধ্যে ভোটের অঙ্কে অনেক বিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। নতুন প্রজম্মের ভোটাররা ঠিক কোন দিকে বেশি ঝুঁকে আছেন তা জানার জন্যে আরেকটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফল হাতে পেতে হবে। টানা তিন মেয়াদের শাসন শোষণে অতীষ্ঠ জনগণ সুষ্ঠু ভোটের প্রথম সুযোগেই আওয়ামী লীগকে যে প্রত্যাখ্যান করবে তা বিভিন্ন সরকারি জরিপেই উঠে আসছে। সে কারণে কোন অবস্থাতেই জনমতের প্রতিফলন ঘটে এমন নির্বাচনের পথে হাঁটতে বর্তমান শাসক দলের বেজায় অনীহা।
আগামী দিনে ন্যুনতম সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবে সে আভাস পরিষ্কার। তবে আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ঠ সব ভোটই যে ধানের শীষে পড়বে এমন ধারনার ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেন অনেকে। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপি’র নেতৃত্বের ভঙ্গুরতা, আদর্শিক শৈথল্য, শহীদ জিয়ার সমন্বয়ের রাজনীতির আংশিক বিচ্যুতি, ইসলামপন্থী দলগুলোকে যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থতা, দলীয় নেতৃত্বে বাম প্রভাব সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফল বিএনপি কতটা ঘরে তুলতে পারবে তা নিয়ে সংশয় অমূলক নয়। ২০০১ থেকে ২০২৩- এই ২২ বছরের ব্যবধানে বিএনপি আওয়ামী লীগ বিরোধী বৃহৎ ভোট ব্যাংক কতটা সংহত রাখতে পেরেছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পুরোপুরি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও বিএনপিকে এসব বিষয় মাথায় নিয়ে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। মাঠ ভরা সোনালী ফসল ঘরে তোলার মতো দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও পরিপক্কতার ঘাটতি বিএনপি’র অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী জোটে জামায়াতকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতেন মূলতঃ ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট ও অবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির কর্মীরা তুলনামূলক অদম্য- এমন বিশ্বাস থেকে।
অন্যদিকে আলোচ্য ২২ বছরে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। শীর্ষস্থানীয় ডজনখানেক নেতৃত্বকে হারিয়েছে। প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে। দলীয় নিবন্ধন বাতিল আদেশ উচ্চ আদালতে ঝুলছে। ঘরোয়া সভা থেকেও ঝাঁকে ঝাঁকে নেতা কর্মীর ধরপাকড় নিত্যচিত্র। এর মধ্যেও জামায়াত নেতাদের হিসেব হচ্ছে- সর্বব্যাপী নিপীড়নের মধ্যেও জনশক্তি অনেক বেড়েছে। সাংগঠনিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে। বিশেষতঃ করোনাকালে প্রসার লাভ করা জুম, স্কাইপি, গুগল মিটসহ নানা প্রযুক্তি-নির্ভর যোগাযোগ সুবিধার সদ্ব্যবহার করে সাংগঠনিক তৎপরতা জামায়াতকে বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে। একইভাবে ভোট-ব্যাংকেরও স্ফীতি ঘটেছে বলে তারা মনে করেন।
তবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তি-সামথ্য অর্জন যে এখনো অনেক দূর তাও তারা স্বীকার করেন। সে উপলব্ধি থেকে জামায়াত ৩০ সালা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলেও শোনা যায়। বর্তমানে জামায়াত নেতৃত্বের সিংহভাগই ছাত্র নেতৃত্ব থেকে আসা আধুনিক মনষ্ক। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরাই ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এদের অনেককে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম বলা হচ্ছে। ফলে স্বাধীনতা-বিরোধীতার তকমা তাদের গায়ে লেপে দিয়ে আওয়ামী লীগ খুব বেশি সুবিধা নিতে পারবে না বলে বিশ^াস করেন অনেক পর্যবেক্ষক।
এবার নজর দেয়া যাক ১০ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সমাবেশের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসার প্রসঙ্গে। সরকার কেন নির্বিঘেœ জামায়াতকে শো’ডাউন করতে দিল-এটা বেশি আলোচিত হচ্ছে। এটাকে পর্দার আড়ালে জামায়াতের সঙ্গে ফের সমঝোতা কিনা সে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। ক্ষমতার রাজনীতিতে এ সূত্রতো আরও শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যে সব ধরনের কৌশলই গ্রহণ করবে এটা খুব স্বাভাবিক। প্রচলিত কথা আছে- আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে সঙ্গী, না থাকলে জঙ্গী।
বিশ^াসযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে- জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেফতারের পর দীর্ঘ সময় গোয়েন্দা কার্যালয়ে রিমান্ডে রেখে বোঝাপড়ার চেষ্টা হয়েছে। তা সফল হয়নি বলেই তাঁকে জেলে থাকতে হচ্ছে। সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক গোলাম পরোয়ারও দীর্ঘ সময় কারাভোগ করছেন, জামিন পেয়ে ফের জেল গেটে গ্রেফতার হচ্ছেন-নিরাপস অবস্থানের কারণে। একই ধরনের বোঝাপড়ার চেষ্টা হয়েছে গত ডিসেম্বরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে রাত গভীরে তুলে নিয়ে। সে ক্ষেত্রেও সরকার সফলতার মুখ দেখেনি।
দশকান্তে জামায়াতের মাঠে ফেরাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি সরকার-জামায়াত সমঝোতা হিসেবে দেখছি না। আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে তিনটি কৌশলের অংশ হিসেবে সরকার জামায়াতকে নির্বিঘেœ সমাবেশ করতে দিয়েছে। যদিও প্রথম দফায় বিমুখ করেছে এবং জামায়াতের চাহিদা অনুযায়ী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট দেয়নি। কৌশল তিনটি অন্য অর্থে এক ঢিলে তিন পাখি শিকারও বলা যেতে পরে।
এক. সরকার বুঝতে পেরেছে মার্কিন নতুন ভিসা নীতির সুযোগ নিয়ে জামায়াত সরকারের হাইকমা- ও তার বেপোরোয়া পুলিশ বাহিনীকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে সরকার জেনেছে, অনুমতি না পেলেও জামায়াত বড় শো’ডাউন করতে মাঠে নামবেই।
বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি তাদের শক্তি-সামর্থ্য জানান দিতে মরিয়া। জামায়াতের পরিকল্পিত সেই বড় শো’ডাউন ঠেকাতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। জানবাজ কর্মীবাহিনীর সুসংগঠিত দল জামায়াতকে ঠেকাতে বড়ো রক্তপাতের ঘটনাও ঘটার আশঙ্কা মাথায় রাখতে হয়েছে সরকার ও বাহিনী কর্তাদের। বিদ্যমান বাস্তবতায় এ ঝুঁকি নেওয়া তাদের জন্যে মোটেই সমীচিন নয় বলে বিবেচনা করেই মৌখিক অনুমতি দিয়ে সব কুল রক্ষা করেছে।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, জামায়াত তাদের কর্মসূচি গ্রহণের প্রতিটি বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে নিয়মিত আপডেট দিয়েছে। তারা জানিয়েছে- সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে শান্তিপূর্ণ সমাবেশই তাদের লক্ষ্য। মার্কিন ভিসানীতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে জনসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। জামায়াতের সমাবেশ ঠৈকাতে গিয়ে বড় সহিংসতা হলে ঢাকার বড়ো পুলিশ কর্তাসহ অনেকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঝুঁকি ছিল। অনুমতি চাইতে গিয়ে জামায়াতের কয়েকজন আইনজীবী আটক হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
দুই. জামায়াতকে মাঠে নেমে শক্তি প্রদর্শন করতে দেওয়ার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার অবশিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ-অবিশ্বাস জোরদার করাও সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। বিএনপি এখন জামায়াতের ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে। যুগপৎ আন্দোলনের নানা পর্যায়ে জামায়াত বিএনপি’র শীতল সম্পর্ককে বরফ-জমাটে কিংবা চূড়ান্ত বিচ্ছেদে নিয়ে যেতে পারলে সম্ভাব্য আন্দোলন ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার তার সুফল পাবে। অবশ্য এ কৌশল সরকারের জন্যে বুমেরাংও হতে পারে। বিএনপি এখন জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়ে সম্পর্কের পারদ উর্ধমুখি করতে সচেষ্টা হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তিন. জামায়াতকে মাঠে নামতে দিয়ে সরকার জাতীয় পার্টিকে কঠোর বার্তা দিতে চেয়েছে। বর্তমান ভাগাভাগির পার্লামেন্টের সরকার অনুগত বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান জানান দিচ্ছেন। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন পাতানো নির্বাচনে না যাওয়ার কথাও বলছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় পার্টিকে দেখাতে চাইছে যে, আগামীতে তোমরা বাগে না আসলে প্রয়োজনে তোমাদের চেয়ে সুসংগঠিত শক্তি জামায়াতকে বিরোধী দলের আসনে বসাবো। জাতীয় পার্টির ওপর এক ধরনের স্নায় চাপ তৈরীর জন্যে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জিএম কাদেরের অনুষ্ঠানের জন্যে বরাদ্দকৃত হল আগের রাতে বাতিল করে, তাদের সাজানো মঞ্চ ভেঙ্গে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের হলে সরিয়ে নিতে বাধ্য করে জামায়াতকে সমাবেশ করতে দিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ রাতভর চাপ দিয়ে জামায়াতের জন্যে হল খালি করেছে।
এখানে বলে রাখা ভালো- বহুধাবিভক্ত জাতীয় পার্টির বড়ো অংশের নেতা জিএম কাদের তাঁর বড়ো ভাই এরশাদের মতো আনপ্রেডিকটেবল কিনা তা দেখার জন্যে আরও অপেক্ষা করতে হবে। তিনি যত হুংকারই দেন না কেন মাঠের নড়বড়ে সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে কোন বোঝাপড়ার নির্বাচন ছাড়া জাতীয় পার্টি যে ক্ষমতার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করতে পারবে না তা তিনি না বুঝার কথা নয়। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে ততই জাতীয় পার্টির আসল অবস্থান স্পষ্ট হবে-এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আরেকটি বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি। সরকারের নেক নজরে থাকা দেশের আলোচিত আরেক ইসলামী দল চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচনী রাজনীতিতে উত্থান জানান দিচ্ছে। রংপুরের পর গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে দলটি তাদের উল্লেখযোগ্য ভোট ব্যাংকের জানান দিতে পেরেছে। বরিশালেতো খোদ পীর লড়ছেন। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছেন। এটি জামায়াতের জন্যেতো বটেই, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের জন্যেও শীরঃপীড়ার অন্যতম কারণ। তাই তুলনামূলক মডারেট ইসলামী দল জামায়াতকে রাজনৈতিক স্পেস দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদেরও এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
এই বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ শেষ করার আগে বলে রাখা ভালো, রাজনীতির একজন ঘনিষ্ট পর্যবেক্ষক এবং রাজনৈতিক বিটে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতায় একান্ত নিজস্ব মতামত তুল ধরলাম। নির্মোহ থাকার চেষ্টা করেছি। এতে পাঠকদের যে কোন ভিন্নমতকে স্বাগত যানাই।
লেখক : সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।