বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
হুমায়ুন কবীর, রাজশাহীঃ
নিজের মার্কেটের কর্মকর্তা ও ভাতিজা নাহিদুজ্জামান পাপ্পুর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিবেন রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। বুধবার সাংবাদিকদের এ কথা জানান সংসদ সদস্য।
ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, প্রতারণার ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর পরিকল্পিতভাবে তাকে জড়িয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন পাপ্পুর স্ত্রী বাঁধন জামান। তাদের (নাহিদুজ্জামান ও বাঁধন) বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, সরকারি চাকরি নিয়ে দেয়ার কথা বলে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর একটি মার্কেটের কর্মকর্তা ও তার ভাতিজা নাহিদুজ্জামান পাপ্পুর বিরুদ্ধে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানায় প্রতারণার মামলা করেছেন ভুক্তভোগী যুবক জনি আহম্মেদ। মামলায় নাহিদুজ্জামানের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কেটটির কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যের ভাতিজা নাহিদুজ্জামান ওরফে পাপ্পু (৩০) ও তাঁর স্ত্রী বাঁধন জামানকে (২৮) আটক করে পুলিশ। পরে ওই মামলায় স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার নাহিদুজ্জামানের বাড়ি রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার দড়িখরবোনা এলাকায়। তিনি সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর আপন মামাতো ভাইয়ের ছেলে। তার স্ত্রীর নাম বাঁধন জামান। তার বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুর এলাকায়। পাঁচ মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। মামলার বাদী জনি আহম্মেদের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাত্রাপুর গ্রামে।
পুলিশের হাতে আটকের সময় বাঁধন জামান সাংবাদিকদের বলেন, সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর নির্দেশেই তাঁর স্বামী এই লেনদেন করেছেন। বর্তমানে তার স্বামীর কাছে কোনো টাকা নেই।
পাপ্পুর স্ত্রী বাধনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে বুধবার দুপুরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘‘ওই নারীর (বাঁধন জামান) বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ওই নারীর বক্তব্যের সমর্থনে কী প্রমাণ আছে, এ বিষয়ে কোনো সাংবাদিকের নিউজ করা উচিত নয়।’’
সংসদ সদস্য আরও বলেন, ‘‘নাহিদুজ্জামানের বাবা তার আপন মামাতো ভাই। তার মা ও বাবার অনুরোধে নাহিদুজ্জামানকে তিনি মার্কেটের অ্যাডমিন অফিসার পদে চাকরি দিয়েছিলাম। তিনি তার (নাহিদুজ্জামানের) অপকর্মের বিষয় আন্দাজ করতে পেরে ২০ দিন আগে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তার স্ত্রীর বক্তব্যের একটি ভিডিও তিনি হাতে পেয়েছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন যে তাদের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। তখন পরিকল্পিতভাবে আমাকে জড়িয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’’
মামলার এজাহার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জনি আহম্মেদের সঙ্গে আসামি নাহিদুজ্জামানের পরিচয় হয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুকের মালিকানাধীন মার্কেট থিম ওমর প্লাজায়। সেখানে নাহিদুজ্জামান নিজেকে থিম ওমর প্লাজার কর্মকর্তা এবং সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ভাতিজা বলে পরিচয় দিয়ে জনি আহম্মেদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। জনিকে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখান নাহিদুজ্জামান।
এ জন্য তারা একটি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে চুক্তিপত্র তৈরি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, জনির কাছ থেকে নাহিদুজ্জামান গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বোয়ালিয়া থানার ষষ্ঠীতলা এলাকায় অবস্থিত থিম ওমর প্লাজায় দুই লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে তার কাছ থেকে আরও আট লাখ টাকা নেন। পরবর্তী সময় কনস্টেবল পদে জনির চাকরি না হলে তিনি নাহিদুজ্জামানের কাছে টাকা ফেরত চান। নাহিদুজ্জামান টাকা দিতে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। জনি ওই প্লাজায় গিয়ে টাকার জন্য চাপ দিলে নাহিদুজ্জামান তাকে একটি চেক দেন। জনি চেক নিয়ে টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারেন সেই ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই।
এরপর জনি আবার যোগাযোগ করলে নাহিদুজ্জামান তাকে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বোয়ালিয়া থানার সপুরা ম্যাচ ফ্যাক্টরি মোড়ে টাকা নেওয়ার জন্য আসতে বলেন। জনি সেখানে গিয়ে নাহিদুজ্জামানকে মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পান। তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পান, তার মতো প্রতারণার শিকার অনেক ব্যক্তি টাকার জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন জনি অন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে সবাই মিলে সপুরা ম্যাচ ফ্যাক্টরির মোড়ে আসামি নাহিদুজ্জামানের ভাড়াবাড়িতে যান।
এরই মধ্যে নগরের বোয়ালিয়া থানার পুলিশ ৯৯৯-এ কল পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। সেখানে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয় জানতে পেরে আসামি নাহিদুজ্জামান ও তার স্ত্রী বাঁধনকে পুলিশ আটক করে।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই জনি আহম্মেদ বাদী হয়ে থানায় তাদের নামে মামলা করেন। অন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা মামলার সাক্ষী হয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, আসামি নাহিদুজ্জামান ও তার স্ত্রী বিভিন্নজনকে চাকরি দেওয়া, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন। আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে সহজ-সরল ব্যক্তিদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন।
ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে নাহিদুজ্জামানের প্রতারণার শিকার এক যুবক এসেছিলেন বাগমারা থেকে। তার নাম মিলন রহমান। সহকারী ট্রেন চালক পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নাহিদুজ্জামান তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন। জমি বিক্রি করে ও ঋণ করে তিনি ওই টাকা দিয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে নাহিদুজ্জামান ১০০ টাকা মূল্যমানের দুটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই করে দিয়েছেন।
নাহিদুজ্জামানের কথামতো গত ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম রেল ভবনে যোগদান করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একইভাবে নগরের শালবাগান এলাকার যুবক ইমনের কাছ থেকে নাহিদুজ্জামান সাড়ে ১১ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে দুটি ফাঁকা চেকে নাহিদুজ্জামান সই দিয়েছেন। ট্রেনের গার্ড পদে চাকরির জন্য তিনি এই টাকা নিয়েছেন। খবর পেয়ে রাতে বোয়ালিয়া থানায় আরও অনেকে আসেন। মামলায় আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ ৮৫ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আটকের সময় নাহিদুজ্জামানের স্ত্রী বাঁধন জামান বলেছিলেন, চাকরি দেওয়ার নামে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তার স্বামীর মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন। এ জন্য তার স্বামীকে ওই টাকার ৩০ শতাংশ দেওয়ার কথা ছিল। বাকি ৭০ শতাংশ ওমর ফারুক চৌধুরীর নেওয়ার কথা। কিন্তু তার স্বামীর হাতে কোনো টাকা নেই। সব নিয়েছেন সংসদ সদস্য। এ কথা ফাঁস করলে তার স্বামীকে বাসায় গিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।
সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে ‘রাঘববোয়াল’ বলে সম্বোধন করে সাংবাদিকদের তার কাছে যেতে বলেন বাঁধন। তিনি আরও বলেন, তার স্বামীকে ধরে কোনো লাভ নেই। তার স্বামীর হাতে কোনো টাকা নেই।
নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি সোহরাওয়ার্দী হোসেন বলেন, মামলায় নাহিদুজ্জামান, তার স্ত্রীসহ আরও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।