শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
হুমায়ুন কবীর, রাজশাহীঃ
রাজশাহীতে সবচেয়ে বড় বাজেটের কাজ চলছে নাটোর রোড (রুযেট) হতে রাজশাহী বাইপাস প্রকল্পের চারলেট রাস্তাসহ ও ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ। গত বছরের জুনে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। বরং এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে একের পর এক তথ্য গোপন করা হয়েছে। এতে আরডিএ’র প্রকল্প পরিচালকের জন্য সরকারের এ উন্নয়ন কাজ এখন প্রশ্ন বিদ্ধ।
বলা যায়, বড় বাজেটের সরকারের এ উন্নয়ন নিয়ে রীতিমত নগরবাসীর সাথে কানামাছি খেলছে আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক। এ কাজের শুরু থেকেই নেয়া হয়েছে অনিয়মের আশ্রয়। এ প্রকল্প শুরুর পর জমি অধিগ্রহন থেকে শুরু করে চলমান কাজের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্পটি প্রশ্ন বিদ্ধ। চারলেন রাস্তাসহ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ না করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন, একের অধিকবার সময় বাড়িয়েও কাজ সম্পন্ন না হওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এখন প্রকাশ্য রুপ নিয়েছে। এতো কিছুর পরও প্রকল্প পরিচালকের দাবি, এ কাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি।
জানা গেছে, আরডিএ’র তত্ত্বধায়নে প্রায় ২শ’ ৬ কোটি টাকার এ কাজ চলছে। এরমধ্যে ১শ’ ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভারসহ রুয়েটের পূর্ব-দক্ষিণ কর্ণার হতে মেহেরচন্ডি, চকপাড়া ও খড়খড়ি বাইপাস পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট ৫ কিলোমিটার বিটুমিন কার্পেটিং রাস্তা, ৯৪১০ মি. আরসিসি ড্রেন, ৯টি আরসিসি কালভার্ট, একটি ৮০৫ মিটার দৈর্ঘ বিশিষ্ট ওভারপাস নির্মাণ, ১০ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন, ১০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন, ১০ কিলোমিটার গ্যাস সরবরাহ লাইন, টিএনটি লাইন স্থাপন। এ কাজ করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোমেন লিমিটেড। প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ২২ সালের জুনে। কিন্তু কাজই শেষ হয়নি। আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলীর দেয়া তথ্য মতে, ওভারপাস, চারলেন সড়ক, ড্রেন, কালভার্ট, রাস্তা ও ওভারব্রিজের লাইটিং ও টিএনটি লাইন স্থাপন হয়েছে শতভাগ। কাজ শেষ দেখিয়ে গত বছরের ১৯ জুলাই ও গত ২৪ জুলাই দুই দফায় প্রতিবেদন দাখিল করেছেন প্রকল্প পরিচালক আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, রুয়েট হতে বাইপাস পর্যন্ত যে রাস্তা হচ্ছে তার উপর ভরাট ফেলানো কাজ চলছে। কিছু কিছু জায়গায় ইট খোয়া ফেলা শুরু হয়েছে। রুয়েটের দক্ষিন পাশ থেকে প্রচীরের শেষ পর্যন্ত ড্রেনের কাজ চলছে। ফ্লাইওভারের লাইটিংয়ের শুরুই হয়নি। রুয়েট থেকে বাইপাস ৫ কিলোমিটার চারলেন সড়কের ড্রেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র তিন কিলোমিটার। এক কিলোমিটার ড্রেনের কাজ সবেমাত্র শুরু হলেও বাকি এক কিলোমিটার ড্রেনের কাজ শুরুই হয়নি। ৫ কিলোমিটার রাস্তার কোথাও কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হয়নি। রাস্তার ধারের যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো সবে মাত্র ভাঙ্গা হয়েছে।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর এ বিষয়ে আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, কাজ শেষ হওয়ার দুমাস আগে আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে থাকি। তাই জুলাই মাসে কাজ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। আর কাজ তো হয়েই গেছে, বাকি কাজ সামনে ডিসেম্বর মাসে শেষ হবে। কিন্তু জুলাই মাসে কাজ শেষ হওয়ার প্রতিবেদন দেয়ার পর অতিবাহিত হয়েছে আরো ৮ মাস। তারপরও ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়নি।
এদিকে নাটোর রোড (রুযেট) হতে রাজশাহী বাইপাস প্রকল্পের তথ্য চেয়ে আরডিএ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। এই প্রকল্পের ব্যাপারে আরডিএ কর্তৃপক্ষের কাছে যেসব তথ্য চাওয়া হয় তার সম্পুর্ন তথ্য দেয়নি। আবার যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা পূর্বেও দেয়া তথ্যের সাথে কোনো মিল নেই। আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক সাক্ষারিত তথ্যে বলা হয়েছে, নাটোর রোড (রুয়েট) বাইপাস পর্যন্ত সংযোগ সড়ক শীর্ষক প্রকল্পের বর্তমান কাজগুলো উবভবপঃ খরধনরষরঃু চবৎরড়ফ এবং এর আওতায় যে কাজগুলো চলমান, তা নির্ধারিত উবভবপঃ খরধনরষরঃু চবৎরড়ফ এর পূর্বেই সম্পন্ন হবে। চলমান রাস্তার কাজে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, যার কারণে কাজ সম্পন্ন হয়নি। অথচ তিনি গত বছরের জুলাই মাসে কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রতিবেদন দিয়েছেন।
এ প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাব বিবারণীর তথ্য দিয়েছেন তা হলো, এই প্রকল্পের মোট টাকার পরিমাণ প্রায় ২শ’ ৬ কোটি। এখন পর্যন্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়েছে প্রায় ১শ’ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকার মত। অবশিষ্ট্য আছে ১৪ কোটি ৬৬লাখ টাকা। এই টাকা কাজ শেষ হলে ঠিকাদারকে প্রদান করা হবে। কিন্তু ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে এই প্রকল্পের হিসাব বিবরণীতে (ব্যাংক স্টেটমেন্ট) দেখা যায়, এখনো এই প্রকল্পের একাউন্টে প্রায় সাড়ে ১৭ থেকে ১৮ কোটি টাকা অবশিষ্ট্য রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক এখানে সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার কম দেখিয়েছেন।
এছাড়াও গত আট বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৭ কোটি টাকার কোনো হিসাব নেই। গত বছরের ২৭নভেম্বও রাজশাহী জেলা প্রশাসন ওই ১৭ কোটি টাকার কাগজপত্র চেয়ে আরডিএ কর্তৃপক্ষকে নোটিশ করেছিলো। এই টাকা কোথায় ব্যয় হয়েছে, নাকি এখনো ওই টাকা ব্যাংকে আছে তা জানতে চেয়ে জেলা প্রশাসন চিঠি দেয় আরডিএকে। এমনকি এই টাকা সমন্বয়ের কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সেই ১৭ কোটি টাকা কোথায় তা আরডিএ কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনকে জানাতে পারেনি। তবে প্রকল্প আট বছর আগে শেষ হলেও এখনো ভুমি অধিগ্রহণের টাকা শোধ হয়নি।
সম্প্রতি পূর্ত অধিদপ্তর সেগুন বাগিচা ঢাকা থেকে আরডিএ-এর প্রতিটি শাখায় তথ্য অডিট করা হয়েছে। অডিট অফিসাররাও এসব তথ্য নিয়ে গেছে। তাদেরকেও এমন গড়মিল তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও রুয়েট হতে বাইপাস প্রকল্পের গত বছরের জুনের পর আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বেশ কিছু চেক প্রদান করা হয়েছে। যা সম্পুর্ন অবৈধ। কারণ এই প্রকল্পের কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে। গত বছরের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় তা দিতে পারেনি।
বিষয়টি নিয়ে আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক গণমাধ্যমকে বলেন, এগুলো নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। আপনি তথ্য চেয়েছেন তথ্য দিয়েছি। তিনি বলেন, আপনার সাথে আর কোনো কথা নেই। আমরা কাজ করছি এটাই শেষ কথা। তিনি বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আপনি যা করছেন, করেন। আমরা কোনো খারাপ কাজ করছি না, মানুষ মার্ডার করছি না, দুর্নীতি করছি না, কোনো অপচয় করছি না। এরপর আর তিনি কথা বলতে চাননি।