শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
মোস্তাফিজুর রহমান সুজনঃ
প্রকৃতি নির্ভর কুয়াকাটার উন্নয়ন মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন না হওয়ায় মূখ থুবরে পড়েছে পর্যটক এলকা কুয়াকাটার।
কুয়াকাটায় অসাধু ব্যবসায়ীদের কারনে ক্ষুদ্ধ পর্যটকরা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পর্যটন শিল্প নেতিবাচক প্রভাব পরবে সাগরকণ্যা কুয়াকাটায়।
দক্ষিনাঞ্চলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সাথে পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাগরকণ্যাখ্যাত কুয়াকাটায় পর্যটকদের ভীড় বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকের আগমন চোখে পড়ার মত।
এছাড়া ও ছুটির দিনগুলোতে যেন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ঢল নামে সাগরকণ্যা কুয়াকাটায়। তবে সুর্যোদয় আর সূর্যাস্তের লীলাভূমি আর সাগরের বিশালতা উপভোগ করতে এসে ব্যবসায়ীদের সেবার মানসহ নানা বিরম্বনা আর ভোগান্তি নিয়ে গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন পর্যটকরা।
মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন না হওয়ায় পরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে না কুয়াকাটায়। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের কাছে হোটেল-মোটেল গুলোর বাড়তি ভাড়া আদায় কিংবা নিম্ন মানের খাবার সরবরাহ করে অধিক মূল্য আদায় এবং বাসে আসা যাত্রীদের হয়রানি হরহামেশাই ঘটে চলছে।
আর এসব কারণে ক্ষুব্ধ আগত পর্যটকরা। এখনই পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটালে মুখ থুবরে পড়বে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
কুয়াকাটা ঘুরে পর্যটকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে কুয়াকাটা রক্ষায় সৈকতের মূল স্থান জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে কিছু এলাকা বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যত্র তত্র।
অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে পর্যটকদের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটছে। সেখানে রাতে ঘুরতে গিয়ে প্রায়ই আহত হচ্ছেন পর্যটকরা। সৈকতের অবস্থা এখন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। সৈকতে আরেক বিরম্বনা মোটরসাইকেলের উৎপাত।
স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না পর্যটকরা। দর্শনীয় স্পটগুলো ঘুরে ভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে কতিপয় চালকদের খাম খেয়ালীপনায় বিপাকে পরতে হয় পর্যটকদের।
প্রশাসন বার বার নিষেধ করলেও মানছেন না স্থানীয় মোটর সাইকেল সিন্ডিকেট। জানা গেছে, দীর্ঘ আঠারো কিলোমিটার সৈকত, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কুয়াকাটার কুয়া, প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য ছাড়াও রয়েছে বিশাল সাগর, সাগরের ঢেউ আর গর্জন।
দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সাগরের বুকে জেগে ওঠা চর বিজয়, মিস্ত্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহারে এশিয়ার সর্ববৃহত বৌদ্ধ মূর্তি, রাখাইন পল্লী, ঝাউ বাগান, ফয়েজ মিয়ার লেক, পিকনিক স্পট, লেম্বুর বন, লাল কাকবড়ার চর, ফাতরার বন, নারিকেল বাগান, গঙ্গামতির চর, ফ্যালার চর, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান।
আছে প্রায় আড়াইশ বছর আগের পিতল ও কাঠের তৈরী পুরাতন বিশাল নৌকা। রয়েছে শূটকি পল্লী।
ভ্রমন পিপাসুদের অভিযোগ, এসব দর্শনীয় স্পটগুলোর কথা শুনে আর প্রকৃতির খেয়ালীপনা উপভোগ করতে পর্যটকরা আকৃষ্ট হয়ে কুয়াকাটায় আসলেও যাওয়ার সময়ে কুয়াকাটার প্রতি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে।
কুয়াকাটা যারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসেন তাদের সমস্যায় পরতে না হলেও বাসে আশা পর্যটকদের নানান ভাবে হয়রানি করা হয়। রাস্তায় পথে পথে যাত্রী উঠানো, বাস দাড় করিয়ে রাখা এমনকি যাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করাসহ মাঝ পথে নামিয়ে দেয়া হয়।
সম্প্রতি নরসিংদীর বাবুর হাট থেকে আগত ব্যবসায়ী রুবেল তার পরিবারের আট সদস্যকে নিয়ে লঞ্চ থেকে নামার পর বরিশাল থেকে ছন্দা পরিবহন নামের একটি বাসে কুয়াকাটা রওনা হয়।
পথিমধ্যে রুবেলের সন্তান অসুস্থ হয়ে পরে। রুবেল তার নির্ধারিত আসনে সন্তানকে রেখে নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বাসের সুপারভাইজার এসে দাঁড়িয়ে থাকলে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে জানিয়ে উচ্চবাচ্য বাক্য বিনিময় করেন।
এক পর্যায়ে বাসটি কুয়াকাটার তুলাতলি এলাকায় পৌঁছালে বাসের স্টাফরা বাস থেকে নামার সময় তাদের ওপর হামলা ও মারধর করে এবং মোবাইল ভেঙে ফেলে।
এছাড়া হামলার ঘটনা ভিডিও করার অপরাধে পর্যটকের হাতে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলা হয়। পরে হামলার শিকার দম্পতি তাৎক্ষণিক ৯৯৯-এ ফোন করে এ ঘটনা জানালে মহিপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাসের চালক মো. কামাল ও সুপার ভাইজার জামালসহ ওই পর্যটকদের থানায় নিয়ে যান।
এবং সাধারণ ডায়রি নিয়ে মহিপুর থানার ওসি আলোচনা করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন।
মারধরের শিকার ওই পর্যটকরা আরো জানান, কুয়াকাটা এসে এমন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তাহলে এখানে আসতাম না।
এতো কষ্ট আগে কখনো পাইনি। খুলনা থেকে ঘুরতে আসা চাকুরীজীবী ইশরাত হোসেন, শামিমা হক, সাব্বির হোসেনসহ বহু পর্যটকদের অভিযোগ, কুয়াকাটায় অধিকাংশ হোটেল মোটেল গুলোর মান ভালো না হলেও পর্যটকদের বাড়তি চাপ দেখলেই হোটেল গুলোর রুমের ভাড়া তিন থেকে চার গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।
একটু ভাল মানের হোটেলে থাকার ইচ্ছা হলেই পাচ তারকা হোটেলের ভাড়াও গুনতে হয় অনেককে। এছাড়াও খাবার হোটেল গুলোয় মাঝে মধ্যেই পঁচা বাসি খাবার সরবরাহ করছেন। পাশাপাশি খাবারের তালিকার চেয়ে বাড়তি দাম রাখা হয়।
পর্যটকরা আরও জানান, সৈকত লাগোয়া ফ্্রাই ও বারকিউ’র দোকান গুলোয় গলাকাটা দাম রাখছে অহরহ। দাম জিজ্ঞাসা করলে বলে এক, খাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করতে গেলে তারা নানান টালবাহানা করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের চাহিদামত টাকা না পরিশোধ করলে খারাপ আচরন করে দোকানীরা। এতে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে।
পর্যটক আব্দুস সালাম আরিফ বলেন, গত মঙ্গলবার ঘুরতে গিয়ে হোটেল রুচিতায় সকালের ভাত, পতলা ডাল, আলু ভর্তা ও একটি ডিম ভাজির দাম জন প্রতি বিল রেখেছেন একশ টাকা। যার মূল্য সর্বসাকুল্লে হওয়া উচিত ৬০ (ষাট) টাকা।
আমরা এখানে প্রায়ই ঘুরতে আসি তাই খাবার হোটেলের গলাকাটা মূল্য আদায়ের বিষয় গুলো এখন নিত্য দিনের ঘটনা। এ বিষয়ে প্রশাসনের নজর দেয়া উচিৎ। না হলে পর্যটন শিল্পে ধস নামবে।
সরকারী লাইসেন্স না থাকায় সম্প্রতি চার আবাসিক হোটেল মালিককে ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং খাবারের দাম বেশি রাখা এবং পচা ও বাসি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য সরবরাহ করায় চার ব্যবসায়ীকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা করে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর।
এদিকে পদ্মা সেতু চালুর হওয়ার পর থেকেই কুয়াকাটায় পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে। তবে এখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলেও সে অনুপাতে পর্যটকদের সেবার মান বাড়েনি।
আর এ কারণে কুয়াকাটার প্রতি পর্যটন কর্পোরেশনের বাড়তি নজরদারি প্রত্যাশা করছেন পর্যটকরা।
ঢাকা থেকে আগত পর্যটক ডা. নুসরাত জাহান বলেন, ‘পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় পরিবারসহ কুয়াকাটা এসেছি। কিন্তু এখানের খাবারের মান তেমন ভালো না, দামও অনেক বেশি। এছাড়া থাকার হোটেলের সেবাও তেন ভালো না।
পর্যটকের ভিড় হওয়ার সুযোগে আমাদেরই অধিক ভাড়া দিয়ে থাকতে হচ্ছে। এটা গলাকাটা অবস্থা। এ বিষয়ে প্রশাসনের দেখা উচিৎ না হলে পর্যটক একবার আসলে দ্বিতীয়বার আর আসবে না।
কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, ‘পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বহুবার হয়েছে। বিশেষ করে পটুয়াখালী ও বরিশালের বাস স্টাফরা পর্যটকদের সঙ্গে অসদাচরণ করে আসছে।
বাস মালিকদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এর একটি সমাধান হওয়া দরকার। না হয় কুয়াকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন পর্যটকরা।’ অপার সম্ভাবনার কুয়াকাটায় এখনই প্রশাসনের উদ্বোগ নেয়া উচিত।
না হলে কুয়াকাটার ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। এছাড়াও বেশ কিছু সমস্য রয়েছে পর্যটকদের সেবার বিষয়ে।
তিনি বলেন, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের উপচে পরা ভীর হয়। তখন কতিপয় হোটেল মালিকরা তিন, চার এমনকি পাচ হাজার টাকা পর্যন্ত সুযোগ বুঝে ভাড়া বাড়িয়ে নেয়। যার ভাড়া আছে সর্ব্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। কে বলবে কার কাছে। পর্যটকরা প্রতারিত হচ্ছেন।
কুয়াকাটা গেষ্ট হাউসের পরিচালক ও কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব শরিফ বলেন, ‘আমাদের এসোসিয়েশনের ৭৫ টি রয়েছে তালিকাভুক্ত।
তালিকাভুক্ত ছাড়া বাহিরে আছে ৫০ টির মতো। আমাদের তালিকাভুক্ত হোটেল মোটেল গুলোতে ভাড়া নির্ধারিত করা রয়েছে এবং চার্ট টাঙানো আছে। এসব হোটেল গুলো যদি পর্যটকদের থেকে বেশি ভাড়া নেয় এমন প্রমাণ ও অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল খালেক বলেন, ‘পর্যটকদের যাতে কোনো ধরনের হয়রানি না হতে হয় তাই আমরা ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের সর্বোচ্চ সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং পর্যটন বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সার্বক্ষনিক কাজ করে যাচ্ছি।’ আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
পটুয়াখালী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহম্মদ সেলিম বলেন, সম্প্রতি কুয়াকাটার এমন পরিস্থিতির কারনে বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল ও আবাসিক হোটেল কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে।
জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ অভিযান পরিচালনা করছেন। অভিযোগ পেলে এ ধরনের অভিযান আবারও পরিচালনা করা হবে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, কুয়াকাটা পরিকল্পিত উন্নয়নে মাস্টার প্লানটি বর্তমানে নগর উন্নয়ন বরিশাল আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে রিভাইজ হচ্ছে।
আর পর্যটকদের সেবা নিয়ে প্রতারিত ও পচা-বাসি খাবারের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার ও প্রশাসন প্রায়ই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে আসছে। তবে আমরা পর্যটকদের সেবা দেয়ার বিষয়ে তৎপর রয়েছি।
পটুয়াখালীর নবাগত জেলা প্রশাসক ও কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, আমি সময় নিয়েছি। এ বিষগুলো নিয়ে আমরা একটি মিটিং করেছি।
এখানে আমরা একটি বীচ ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করতে যাচ্ছি। একটি টিম সব সময় এখানে কাজ করবে। আমরা তাদের নিয়োগ দিতে যাচ্ছি।
লোকজন বাছাই করতে হয়, একটু সময়তো লাগবে। টিমের সদস্যরা সার্বক্ষনিক নজরদারী করবে। যে কোন ধরনের অনিয়ম থাকলে এখানে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। সেখানেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে।