বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
অর্থনৈতিক শব্দের অর্থ হলো, অর্থ বা টাকা-পয়সাসংক্রান্ত। আর সাম্য মানে সমতা, সমান ও ঐক্য। অতএব শব্দগত অর্থে সাম্য বলতে সমাজে সবার সমান অবস্থানকে বোঝায়। কিন্তু এই অর্থের আলোকে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ধারণা বাস্তবতা বিবর্জিত।
কেননা সমাজে সবাই সমান নয় এবং সবাই সমান যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। প্রকৃত অর্থে সাম্য বলতে এমন এক সামাজিক পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে দেশের সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করে এবং সে সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে সবাই নিজ নিজ দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারে, যেখানে কারো জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নেই। যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকের কাজ করার ও ন্যায্য মজুরি পাওয়ার সুযোগই প্রকৃত অর্থনৈতিক সাম্য। এটাকে অর্থনৈতিক সুবিচার বা সামাজিক সুবিচারও বলা যায়। এই চিন্তাকে ইসলাম স্বাগত জানায়।
স্তরভেদে অর্থনৈতিক পার্থক্য পরীক্ষাস্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি পৃথিবীতে তোমাদের খলিফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের একজনকে আরেকজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো, তোমাদের তিনি যা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করবেন। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬৫)
রিজিকের তারতম্য গণমানুষের প্রয়োজনে অপরিহার্য। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তারা কি তোমার রবের অনুগ্রহ বণ্টন করতে চায়? পার্থিব জীবনে আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দিয়েছি। তাদের কিছু লোককে অন্যদের ওপর মর্যাদা দান করেছি। এটা এ জন্য করেছি, যাতে তাদের কিছু লোক অন্যদের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে…। ’ (সুরা জুখরুফ, আয়াত : ৩২)
সৃষ্টিগত নিয়মে মানুষের রিজিকে ব্যবধান বিদ্যমান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার রব যার জন্য ইচ্ছা তার রিজিক বর্ধিত করেন আর যার জন্য ইচ্ছা তা সীমিত করেন। তিনি তো তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত, সর্বদ্রষ্টা। ’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩০)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীর কুঞ্জি তাঁরই (আল্লাহর) কাছে। তিনি যার জন্য ইচ্ছা তার রিজিক বর্ধিন করেন এবং (যার জন্য ইচ্ছা) সংকুচিত করেন। তিনি সব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। ’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ১২)
পবিত্র কোরআন এই প্রাকৃতিক অসাম্যকে ঠাণ্ডা মাথায় মেনে নেওয়ার জন্য মানুষকে উপদেশ দিয়েছে।
ইসলামের গোটা স্কিমের মধ্যে কোথাও এমন ধারণার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত অসাম্যকে নির্মূল করে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা, যেখানে সবাই সাম্যের ভিত্তিতে জীবিকার উপায় উপকরণ লাভ করবে। মহান আল্লাহ অন্যদের যে মর্যাদা ও অনুগ্রহ দান করেছেন, তার জন্য ইর্ষান্বিত না হতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের একজনের চেয়ে অন্যজনকে আল্লাহ যা কিছু বেশি দিয়েছেন, তোমরা তার জন্য লোভ করো না। পুরুষ যা অর্জন করেছে, তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করেছে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩২)
স্বভাবগতভাবে কোনো মানুষ চায় না অর্থনৈতিক জীবনে অন্য কেউ তার সমান হয়ে যাক। মালিক চায় না, শ্রমিক তার সমান টাকার মালিক হয়ে যাক। অন্যথায় পৃথিবীর এই কাঠামো টিকে থাকবে না। শ্রমিক যদি মালিকের সমান টাকার মালিক হয়ে যায়, তাহলে সে আর শ্রম দেবে না, সে নিজেই মালিক হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআনে বিষয়টিকে এভাবে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের দাস-দাসীদের (কর্মচারীদের) নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়…। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭১)
সুতরাং অর্থনৈতিক সাম্য অর্থনৈতিক সমতা অর্থে বাস্তবতা বিবর্জিত। কিন্তু অর্থনৈতিক সুবিচার অর্থে যথার্থ। আর কোরআন সেই চিন্তাকে সাধুবাদ জানায়।