শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

সরকারি অফিসে আমলাদের পাঠ্যভ্যাস গড়তে সাড়ে নয় কোটি টাকার বই কেনা প্রসঙ্গে

সরকারি অফিসে আমলাদের পাঠ্যভ্যাস গড়তে সাড়ে নয় কোটি টাকার বই কেনা প্রসঙ্গে

অ আ আবীর আকাশ

সরকারি দপ্তরে আমলাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি অফিসে পাঠাগার গড়ে তুলতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সাড়ে নয় কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এইসব টাকা দেশের প্রতিটি বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ৪ হাজার বই ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে ২ হাজার বই কিনে তা বুক সেলফে সাজিয়ে রাখতে ইতোমধ্যে স্ব-স্ব দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে স্থানীয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে।

সরকারি দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা কোন কোন লেখকের কি কি বই পড়বেন, কোন কোন বিষয়ে কি কি বই খরিদ করবেন সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে লেখক ও বইয়ের নাম উল্লেখ করে চিঠিও দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দেশের খ্যাত প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক ছড়াকার গবেষকের বইয়ের কথা না লিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবিরুল ইসলামের একলা ২৯ টি বইয়ের নাম দেয়া হয়। এভাবে প্রেরিত চিঠিতে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত সরকারি আমলাদের বইয়ের নামই দেয়া হয়েছে।

যেখানে দেশের স্বনামধন্য কবি সাহিত্যিক গবেষক লেখকের নাম বাদ রয়েছে। এতে করে আলোচনা সমালোচনার হচ্ছে সর্বত্রই। সাড়ে নয় কোটি টাকার বই সরকারি অফিসে বুক সেলফে সাজিয়ে রাখা হবে। সরকারি দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন জ্ঞান আহরণ করবেন, আচার ব্যবহার সততা দেশপ্রেম মাতৃত্ববোধ ভাতৃত্ববোধ জেগে উঠবে, জনগণের সাথে কিভাবে কথা বলবে, কিভাবে সেবা দিবে এসব শিখতেই মূলত পাঠাগার গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মনে করে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা, বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মচারী জনগণের সাথে সদাচারণ করতে ব্যর্থ তাই বিভাগীয় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসে বুক সেলফ তৈরি করে ৪ হাজার ও ২হাজার বই রেখে পাঠ্যভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই হবে, এতে তারা ভালো কিছু জ্ঞান পাবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবিরুল ইসলামের ২৯ টি বইয়ের মধ্যে একুশটি বই কবিতা গ্রন্থ, বাকি যে আটটি বই তা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একই পটভূমি বা পাশাপাশি ফটোভূমি নিয়ে লেখা। পাঠক এসব বই পড়লে বিরক্তই হবেন। সরকারি দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাঠ্যভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল কোন চিন্তা থেকে?
এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু? বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন নবীন প্রবীণ লেখক, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা থেকে যে হারে বই পত্রিকা ম্যাগাজিন সংকলন আসে তার উপরে এক পলক চোখ রাখার সময় কি কর্মকর্তা কর্মচারীদের হয়?
আমার জানামতে মোটেই না। স্বচক্ষে দেখা লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসা দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থার বই সংকলনসহ সবগুলো বই নিয়ে ডিসি একটা কক্ষ বরাদ্দ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। সেখানে একজন কর্মচারী রেখেছেন। খবর নিয়ে জানলাম গত দুই বছরে কেউ একটা বই ছুঁয়েও দেখে নি। তাদের আয় ইনকামে সময় পার হয়ে যায়। সেদিকে ব্যস্ত থাকায় বই পড়ার, ছুঁয়ে দেখার সময় কই!

বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা কার্যালয় সমূহ হচ্ছে সর্বময় জনগণের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। ওখানে সেবা দিতে এসে কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা কখন বই পড়বেন? এর কিন্তু সঠিক কোন নির্দেশনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পেরিত চিটিতে উল্লেখ করা হয়নি। তবে কি তারা জনসভা রেখে বই পড়বেন? বই পড়াতে কি তাদের উপর চাপ দেয়া হচ্ছে? কে জানে। নাকি মা শিশুকে জোর করে নাক চেপে ধরে ওষুধ গিলিয়ে দিচ্ছেন? সেরকম কিছু হবে হয়তো।

বই কেনায় বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রেরিত চিটিতে বইয়ের যে তালিকা দিয়ে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন তাতে ওই মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলামের একলাই ২৯ টি বইয়ের নাম দেয়া হয়েছে। প্রথিতযশা লেখকের নাম ও বই না থাকায় এটাকে অপরাধ হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। আমিও এটাকে অন্যায় হয়েছে বলতে পারি। তার একলা একজনের এত বই থাকবে কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় নবিরুল ইসলামের কবিতা নিয়ে দারুন সমালোচনা তৈরি হয়েছে, ইতোমধ্যে তা আমরা দেখেছি। কি ধরনের লেখা উনি লিখতে পারেন? কি ধরনের চিন্তা উনি করতে পারেন তা আমরা ইতোমধ্যে টের পেয়ে গেছি।
সরকারি দপ্তরে বসে সেবা না দিয়ে বই পড়ার বিষয়টি আসলে কেন কিভাবে নেয়া হয়েছে তা খোদ ডিসি ইউএনওরাও বলতে পারছেন না! তাহলে মন্ত্রণালয় বসে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে এটাই সত্য! দেশের এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির দিনে জনগণের টাকা নিয়ে কি দারুন হরিলুট চলছে তাই স্পষ্ট। যার যেরকম মনে হচ্ছে খাত তৈরি করে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। এটা যে কত ভয়ানক দুর্নীতি চুরি লুটের আওতায় পড়ে তা দেখবে কে! সরকারি দপ্তরে বসে সেবা না দিয়ে বই পড়ার যে রুচিবোধ তৈরি করতে চলেছে সরকার তা কর্মস্থলে কাজ ফাঁকি দেয়ার সমান। এমনিতে কর্মস্থলে কাজ ফাঁকি দিতে সদা চেষ্টায় ব্রত থাকে, তার উপরে পাঠ্যভ্যাস গড়ে তুলতে কেন এত তোড়জোড়!
সাড়ে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া মানে কি একেবারে ছোটখাট বিষয়? মোটেও না। দেশের এই কঠিন সময়ে জনগণের টাকায় আমলাদের মেধায় শান দেয়ার নামে কেবলই অর্থের অপচয় নয়, এটাকে একটা অপরাধ বলব আমি। সরকারি যত আয়ের খাত রয়েছে, যেমন- বিমান, রেল, ব্যাংক, তেল, সার, কাগজ, পাট, চিনি ও বস্ত্রসহ আরো নানা আয় বর্ধক প্রতিষ্ঠান তার সবকটিতেই লোকসান। রেলে এবার দেড় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।মানে এগুলো জনগনেরই টাকা। কেন রেলে কি মানুষ চড়ে না? তাহলে লোকসান কেন? অসাধু চোর কর্মকর্তা কর্মচারীদের লাগামহীন চুরির কারণে দেশ রসাতলে চলে যাচ্ছে। এদের ধরে মাথা কামিয়ে চুনকালি ও গলায় জুতার মালা দিয়ে ঘোরালেও হুঁশ ফিরবে না।

সরকারি আমলাদের বই পড়ার সুযোগ নেই। তারা পড়ালেখা না করেই কি সরকারি চাকরি পেয়েছে? যদি তাদের মেধা মননে নম্রতা ভদ্রতা আচার-আচরণে শিক্ষা পরিস্ফুটন না হয় তাহলে কি অযোগ্যরাই মামু খালু ও অর্থের বিনিময়ে বা ঘুষ দিয়ে বিভাগীয় কমিশনার,ডিসি, এসপি ইউএনও হয়েছে? কে বলবে! হঠাৎ কোন মন্ত্রীর মাথায় ভুত ছেপেছে টাকা মারার নতুন ফন্দি খুঁজতে গিয়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়তে ছেয়েছে। এটা পুরোটাই একটা অযৌক্তিক বিষয়।
সার্ভিস দিতে এসে বসে বসে বই পড়বে? নাকি দুপুরে খাওয়া-দাওয়া নামাজ বাদ দিয়ে বই পড়বে? নাকি বাসায় স্ত্রী সন্তান রেখে বিকেল বেলায় বসে বসে বই পড়বে? নাকি ফজরের নামাজ পড়েই অফিসে এসে বই পড়া শুরু করবে? এমন কোন সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা উল্লেখ করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রেরিত চিটিতে। বই পড়বে কখন? হাফ বেলা অফিস করে বাকি হাফ বেলা বই পড়বেন?
বই কেনার বিষয়ে এত কৃপণতা ছোটলোকি মনোভাব দেখা গেছে যে আমলাদের বই ছাড়া বাহিরের লেখকের বই তেমন তালিকায় আননি। কেন আনেনি তার জবাব দেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিভাগীয় শহর জেলা ও উপজেলার স্থানীয় লেখকদের বিভিন্ন বই আঞ্চলিক গবেষণা ইতিহাস ঐতিহ্য লোকসাহিত্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাস মূলক বই তালিকায় রাখা প্রয়োজন ছিল। যেন কর্মস্থলে জেলা উপজেলা সম্পর্কে ধারণা পান ডিসি ইউএনও ও বিভাগীয় কমিশনার। স্থানীয় সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য লোকসাহিত্য বিশ্বাস সম্পর্কে কতটুকু জানেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার ডিসি এসপি ইউএনও? মোটেও জানেন না। তাদের এসব জানতে স্থানীয় লেখক কবি সাহিত্যিক গবেষক সাংবাদিক রচিত আঞ্চলিক বইয়ের দিকের সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে। তাদের খুঁজে বের করে আঞ্চলিক বইয়ের নাম তালিকাবদ্ধ করতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসক ও ইউনিও কার্যালয়ের অভ্যন্তরে পাঠাগার নির্মাণ হলে সে পাঠাগারে স্থানীয় কবি সাহিত্যিক গবেষক সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। রেজিস্টার খাতায় নাম লিপিবদ্ধ করে, ‘বই পড়ে ফেরত দেবো’ শর্তে বই দেয়া যেতে পারে। এই বই শুধু মাত্র কর্মকর্তা কর্মচারিরাই পড়বে তা নয়, এটা স্থানীয় লেখকের জন্য উন্মুক্ত করে পড়ার সুব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ বই কেনার টাকা তো জনগণেরই।

লেখক কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক। করসপন্ডেন্টঃ লন্ডন টাইমস,ইউকে

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০