শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বে তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না। বর্তমানে বিশ্বে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ইউক্রেন থেকে পণ্যসামগ্রী অন্যান্য দেশে সরবরাহের ফলে বিশ্ববাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে আশা করি।
কিন্তু সম্প্রতি আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দামে তার প্রভাব পড়েছে। পণ্যের দাম বেড়েছে।
এটি খুবই স্বাভাবিক যে জ্বালানি তেলের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। শুধু পরিবহন ভাড়াই নয়, সব পণ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের যাবতীয় পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার প্রধান মাধ্যম সড়ক পরিবহন। কেননা আমাদের কোনো পণ্যই স্থানীয় প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, দেশের বাইরে থেকে পণ্য আমদানি করতে হলেও প্রশ্ন জ্বালানির। ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আমরা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারি না।
এ ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তা আরো কঠিন। সরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে আসছে এবং কিছু পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু তাতেও তেমন কাজ হচ্ছে না। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের ভোগ্য পণ্য ও সেবা খাতে প্রভাব ফেলতে শুরু করবে। এরই মধ্যে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়তে পারে। কেননা বিদ্যুতের সঙ্গেও পণ্যমূল্যের সম্পর্ক আছে।
দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। তাদের আয় বাড়ার তেমন সুযোগ নেই; কিন্তু বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। একজন দিনমজুর তাঁর দৈনিক মজুরির পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেও কাজ কতটুকু হবে, তা বলা মুশকিল। কেননা যিনি বা যাঁরা তাঁর দ্বারা কাজ করাবেন তাঁরও সামর্থ্য থাকতে হবে কিংবা মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে। তাঁর পেশা অনিশ্চিত এই অর্থে কাজ পেলে টাকা, নইলে খাবার নেই। ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে সমন্বয়ের নামে অতিরিক্ত মূল্য দাবি করলেও সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই। তাঁদের দোহাইটা বড় অস্ত্র। সাধারণ মানুষকে চোখ বুজে সব কিছু সহ্য করতে হয়। খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হয় কিংবা না খেয়ে থাকতে হয়।
পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া বড় বিষয়। কাজেই নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বাভাবিক রাখার প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। সরকার এখানে বড় স্টেকহোল্ডার। পাশাপাশি বেসরকারি ও অন্যান্য সংস্থা, যাদের স্বল্প বেতনভোগী কর্মচারী রয়েছে, তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যেমন অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তেমনি সামাজিক প্রভাবও কম নয়। সমাজে সামাজিক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এমনিতেই সামাজিক অপরাধের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এই অপরাধের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। বেড়ে যেতে পারে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো সামাজিক অপরাধ।
নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশকে আরো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা জরুরি। তাদের ভাতার পরিমাণ এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এর বাইরে তারা যেন সহজে এবং কম দামে পণ্যসামগ্রী কিনতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অনেক দিনের দাবি সব মানুষের জন্য একটি ডাটাবেইস তৈরি করা। এটি থাকলে সাহায্যের উপযুক্ত ব্যক্তিটিকে বেছে নেওয়া সহজ হয়। শুধু তা-ই নয়, নতুন করে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে না। সঠিক ব্যক্তিকে সাহায্যের আওতায় আনার জন্য বিষয়টি দরকার। এটি যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে আমাদের দারিদ্র্য কমবে না, বরং যার দরকার নেই সে আরো লাভবান হবে। আমরা অহরহ দেখে আসছি ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পছন্দমতো তালিকা তৈরি করে প্রকৃত দরিদ্রদের বঞ্চিত করেন।
সরকারি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা একসময় রেশনের আওতায় থাকতেন। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে না। তাঁরা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। তাঁদের জন্য রেশনের, নয়তো মহার্ঘ্য ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত। বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো একটি পথ বেছে নেওয়া দরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও তাঁদের কর্মচারীদের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষের একটি অংশ পোশাক কারখানায় কর্মরত। কাজেই ভর্তুকি দিয়ে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ দিলে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা সহনীয় থাকবে।
এভাবে প্রত্যেকে তাঁদের কাজে নিয়োজিত কর্মীদের বিষয়ে সচেতন হলে নিম্নবিত্ত মানুষরা একটু স্বস্তি পাবেন। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা নাগালের মধ্যে থাকবে। তবে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। আমাদের বড় অংশ সাধারণ খেটে খাওয়া অনির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত মানুষ। তাদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে হোক, কম মূল্যে পণ্য কেনার কার্ড দিয়ে হোক, ওএমএসের মাধ্যমে পণ্য কিনতে সহায়তা হোক, সরাসরি আর্থিক সহায়তা হোক, কাজের বিনিময়ে খাদ্য হোক, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে হোক—যেকোনোভাবে নিম্নবিত্ত মানুষকে সহায়তা করতে হবে। যত দিন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসে এবং আমাদের দেশের উৎপাদিত ভোগ্য পণ্যের দাম না কমে, তত দিন পর্যন্ত এ যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
একটি স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনীতি গোটা দেশের উন্নয়নের জন্য দরকার, যেখানে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। কেননা সরকারের একার পক্ষে কর্মসংস্থান অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য শুধু ভর্তুকির মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জনই নয়, সবার জন্য কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে সক্ষমতাকে বিচেনায় আনতে হবে। এতে সুষম ও ভারসাম্যমূলক সমাজ তৈরি করা সহজ হবে এবং দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।