শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। পৃথিবীর যুদ্ধকবলিত ও নানা কারণে সংকটাচ্ছন্ন দেশ বা অঞ্চলের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। কারণ, তারা জীবনটা বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করছেন প্রতিনিয়ত। তেমনি একটি দেশ সিরিয়া। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটির ৪০টি অসহায় পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র সম্প্রতি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। যা সত্যিই মনুষ্য-বিবেককে তীব্রভাবে নাড়া দেওয়ার মতো। কীভাবে তাদের রমজান পালিত হচ্ছে, তা জানাচ্ছেন মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রমজান সিরিয়ান মুসলিমদের জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসত। তারা পরস্পরকে অভিনন্দন জানাত। রমজানের আগেই প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে রাখত। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দমুখর রমজান উদযাপন করত। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চিত্র সিরিয়ার রমজান-সংস্কৃতি বদলে দিয়েছে। রমজান এখন তাদের অতীতের স্মৃতি ও ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা থেকে পৃথক কিছু না।
কেননা, বেশির ভাগ সিরিয়ান নাগরিকই বিপর্যয় ও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। যুদ্ধ তাদের পরিবার ও ঘর-বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তাদের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দামেস্কের বহু দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানদার জর্দান ও লেবাননের মতো জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
যুদ্ধের কারণে সিরিয়ায় অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফল ও সবজির জন্য অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও বহু পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেছে। ফলে পরিবার প্রধানরা রমজানের আগমনে আনন্দের পরিবর্তে উদ্বেগ অনুভব করেন।
সিরিয়ায় রমজান উদযাপনে ধর্মীয় উদারতা ছিল গৌরবময় ঐতিহ্য। বহু অমুসলিম রমজানের ইফতার-সেহরির আয়োজনে যুক্ত হতো। কিন্তু যুদ্ধের কারণে মানুষ সমবেত হতে ভয় পায়।
সিরিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য ঈদের তোপধ্বনি এখন আর শোনা যায় না। বিগত পাঁচ বছর তোপধ্বনির পরিবর্তে সিরিয়ানরা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনে থাকে। পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করা বা ইফতার শেষে মসজিদে তারাবি নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতেও ভয় পায় তারা।
তবে সাধারণ এই চিত্রের বিপরীত কিছু চিত্রও দেখা যায় সিরিয়ায়। রমজানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমরা সমবেত হয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। তারা পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর বসবাস করেও তারা সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বার্তা পৌঁছে দিতে ভোলে না।
এ ছাড়া রমজানে প্রতিবেশী আরব ও অনারব দেশগুলো সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাদের ত্রাণ-তৎপরতা বৃদ্ধি করে। এতে সীমান্তবর্তী মুসলিমরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়।
দ্য মুসলিম সিটি নামের একটি সংবাদ মাধ্যম আরব টোয়েন্টিফোর ডটকম নিউজ অ্যাজেন্সির বরাত দিয়ে একটি মর্মস্পর্শী ভিডিও শেয়ার করেছে। ৭ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সিরিয়ার ৪০টি বাস্তুচ্যুত পরিবার সম্প্রতি একটি পরিত্যক্ত স্কুল ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ স্কুল ভবনটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু তা জেনেও মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নেওয়ার দৃশ্যই বলে দেয় তারা অসহায়; কতটা কষ্টে কাটছে ওই ৪০ পরিবারের সদস্যদের জীবন।
আবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিললেও পেটের আগুন (ক্ষুধা) নেভানোর মতো খাবার জোটাতে পারছে না পরিবারগুলো। ওই পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে বলছেন, খেয়ে না খেয়ে আছেন তারা। বড় কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
জাতিসংঘের এক জরিপ বলছে, সিরিয়ার ৮০ শতাংশ জনগণ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এ থেকেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, দেশটির বাকি জনগণের দিন কাটছে কতটা অসহায়ত্বের সঙ্গে!
তবু সিরিয়ার অবরুদ্ধ শহর দৌমার বাসিন্দারা কোনোমতে ইফতার করছেন, এমন কিছু ছবি অনলাইনে ব্যাপক শেয়ার হচ্ছে। বিবিসি ট্রেন্ডিং তার চিত্র তুলে এনেছে।
রাজধানী দামেস্কের কাছেই অবস্থিত দৌমা এলাকা। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এই এলাকার বেশির ভাগই এখন ধ্বংসস্তুপে নিমজ্জিত। কিন্তু এরই মধ্যে সেখানকার বাসিন্দারা একসঙ্গে ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন।
বাসিন্দাদের জন্য এ রকম ইফতারের আয়োজন করেছেন সিরিয়ান আদালেহ ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে তার কার্যক্রম শুরু করে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রতি পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌটা এলাকায় সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ শুরু হয়। রমজানের শেষ দশ দিন প্রতিষ্ঠানটি দৌমার বাসিন্দাদের খাবার সরবরাহ করে। ‘বিমান হামলার ভয়ে আমরা সাধারণত এ ধরনের আয়োজন করি না। কিন্তু সাম্প্রতিক চুক্তির সুবিধা আমরা নিচ্ছি।’ মানবাধিকার সংস্থার একজন কর্মকর্তা এমনটাই বলছিলেন।
সিরিয়ায় চলমান অবরোধ-সংঘর্ষের জেরে সেখানে খাদ্যের দাম অনেক চড়া। ইফতারির জন্য যে খাবার দৌমায় সরবরাহ করা হয়, সেটি তৈরি হয় পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ঘৌটায়। প্রায় চার বছর ধরে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে দৌমা এলাকা। অনলাইনে ছবিগুলো শেয়ার করে অনেকে বলেছে, ‘মৃত্যুর মধ্যে জীবনের ছোঁয়া।’
২০১৬ সালের অক্টোবরের পর গত মাসে প্রথমবারের মতো একটি সাহায্য সংস্থা দৌমায় প্রবেশ করতে পারে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে জায়েশ আল ইসলাম। আর গত কয়েক বছর ধরে এই এলাকাকে লক্ষ্য করে সিরিয়া সরকারি বাহিনী অনবরত বিমান ও বোমা হামলা চালিয়ে আসছে।
শহরের প্রায় একশোর মতো বাসিন্দা একসঙ্গে ইফতার গ্রহণ করছেন। এদের মধ্যে একজন বলছেন, ‘বিমান হামলার ভয়ে আমরা মসজিদে লুকিয়ে ইফতার করেছি অনেক সময়।’ সিরিয়ার একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট টুইটারে ছবিগুলো পোস্ট করে লিখেছেন, ‘দৌমায় মৃত্যুর পরিবর্তে আজ জীবনের ছোঁয়া।’
ছবিগুলো অনলাইনে প্রকাশের পর হাজার হাজার মানুষ তা শেয়ার করছে ও নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। আরেকজন টুইটার ব্যবহারকারী এই খাবারকে বর্ণনা করছে ‘ইফতার অব হিরোজ’ বলে। ‘অনেক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে এই মানুষগুলো মানুষের জন্য কাজ করছে এবং অন্যদের জন্যও উদাহরণ তৈরি করছে।’ লিখেছেন আরেকজন। ছবিগুলো শেয়ার করে রোজাদারদের সুস্বাস্থ্যও কামনা করেছেন সিরিয়ার নামকরা ক’জন সাংবাদিক। অনেক ব্যবহারকারী এটাও বলেছেন, ‘ছবিগুলোতে যে শিশুদের দেখা যাচ্ছে, তারা সবাই যুদ্ধে পরিবার-পরিজন হারানো এতিম।’