বৃহস্পতিবার, ৮ মে ২০২৫

রোজার প্রতিদান ঈর্ষণীয়

এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ

মানবজীবনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা মহান রবের ফরজ বিধান। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোকন। নামাজের মতোই মুসলমানদের প্রতি আল্লাহতায়ালা যে ইবাদত ফরজ করেছেন, তা হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা। দ্বিতীয় হিজরিতে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রোজা ফরজ করা হয়। এর আগে এ রোজা অন্যান্য জাতির ওপরও ফরজ ছিল। কেননা, তা অনন্য ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি ইবাদত। যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের ঈমানি চেতনা সুদৃঢ় হয়। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন হয়। অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।

রোজার আরবি শব্দ সওম, যার আভিধানিক অর্থ—বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়—প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী সব কাজ থেকে বিরত থাকা। এটি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের তৃতীয় রোকন। ইসলামের অন্যান্য বহু আদেশ-নির্দেশের মতোই রোজার আদেশকে ফরজ করা হয়েছে।সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকিম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েজ-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর ওপর পূর্ণ রমজান রোজা রাখা ফরজ। রোজার হুকুম সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

আবার দয়াময় আল্লাহতায়ালা কেবল মাহে রমজানের রোজা রমজান মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেননি, বরং শরিয়তসম্মত কোনো অনিবার্য কারণবশত কেউ রমজান মাসে রোজা পালন করতে না পারলে এরপর অন্য যে কোনো সময় সে রোজার কাজা আদায় করার পথও উন্মুক্ত রেখেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে—‘সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তারপরও তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে, তাহলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের অতিশয় কষ্ট হয়, তাদের কর্তব্য—এর পরিবর্তে ফিদইয়া হিসেবে একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে, তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা তা জানতে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)।

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। তোমাদের জন্য যা সহজ, আল্লাহ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর, তা চান না। এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা কীর্তন করবে। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

কাঙ্ক্ষিত রোজা মুসলমানদের নিয়মতান্ত্রিক পানাহার, চলাফেরা ও ঘুমসহ আধ্যাত্মিক জীবনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে। মোমিন বান্দাগণ রোজার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের আশা করেন। প্রকৃতপক্ষে রোজা মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক নেয়ামত; যার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। রোজাদারের মন পুলকিত হয়। তাই বলা হয়—আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক বড় সুযোগ এই রোজা। আল্লাহতায়ালা তাঁর রহমত ও নেয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডারের দরোজা রোজা পালনকারীর জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পর্যালোচনাসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ৩৮)। হাদিসে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সিয়াম ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু সিয়াম আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সিয়াম বন্দার জন্য ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি সিয়াম পালনকারী। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের গন্ধের থেকেও সুগন্ধি। সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি খুশি—যখন যে ইফতার করে এবং যখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন সওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতের একটি দরোজা আছে, একে রাইয়ান বলা হয়। এই দরোজা দিয়ে কেয়ামতের দিন একমাত্র সিয়াম পালনকারী ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এ পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহ্বান করা হবে, সিয়াম পালনকারীগণ কোথায়? তারা যেন এ পথে প্রবেশ করে। এভাবে সব সিয়াম পালনকারী ভেতরে প্রবেশ করার পর দরোজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করবে না।’ (বোখারি : ১৮৯৬)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘রোজা এবং কোরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দুজনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৫৮৯)।

এসব হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, রোজার প্রতিদান ঈর্ষণীয়। রোজার গুরুত্ব সীমাহীন। দীর্ঘ একটি বছর পর পবিত্র মাহে রমজানের রোজা মোমিনের দরোজায় কড়া নাড়ে। মোমিন একটি মাস রোজা পালন করে, অতঃপর আবার রমজানের রোজা বিদায় নেয়। এভাবেই বছর-যুগ-শতাব্দী ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। যুগান্তরের ঘূর্ণনে আমাদের বয়স বেড়েই চলছে। শুধু হারিয়ে ফেলছি বছরের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। ফজিলত ও বরকতপূর্ণ একটি ইবাদত। ক’দিন পরেই হয়তো জীবনের তরে এ নেয়ামত হারিয়ে যাবে। নেয়ামত থাকবে, তবে আমি হারিয়ে যাব। অতএব, এ মাসকে গুরুত্ব দেওয়া আমাদের জন্য আবশ্যক। রোজার প্রতি যত্নবান হওয়া আমাদের জন্য কর্তব্য। আল্লাহ যেন আমাদেরকে রোজার গুরুত্ব বুঝে আমল করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০
৩১