বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
# ঢাকায় দিনে ২৬০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে ওয়াসা।
# ভূগর্ভস্থ থেকে অবিরাম পানি উত্তোলন করায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে।
# ঢাকায় প্রতি বছর পাঁচ ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে।
# ঢাকার ১০টি জোনে গভীর নলকূপ ৯০৬টি।
# ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের তাগিদ।
ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানির চাহিদা। বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। বসানো হচ্ছে গভীর নলকূপ। পানি সরবরাহকারী সরকারি সংস্থা ঢাকা ওয়াসা বর্ধিত এ পানির চাহিদা মেটাতে আস্থা রাখছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এখন ওয়াসা দিনে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে তার ৬৬ শতাংশই মাটির নিচের। এক যুগে গভীর নলকূপের সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও পানির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে ব্যবহার বাড়াতে না পারলে বাড়বে ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, অবিরাম ভূর্গভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করতে থাকলে ঢাকায় ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে। ওয়াসাকে মাটির নিচের পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করে সরবরাহে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম এ খানের দাবি, রাজধানীতে পানি সরবরাহে ভূ-উপরিস্থ উৎসে জোর দেওয়া হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
গভীর নলকূপ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ
২০০৯ সালে মাটির নিচের পানি ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে রাজধানীর মানুষের চাহিদা মেটাতে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন বলা হয়েছিল গভীর নলকূপ কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। উৎপাদন করা হবে টেকসই, গণমুখী ও পরিবেশবান্ধব পানি। কিন্তু গত এক যুগে উল্টো ঢাকায় গভীর নলকূপ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
ওয়াসার প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ৫১৯টি। এরপর প্রতিবছরই নতুন নতুন নলকূপ বসানো হয়েছে। এসব নলকূপ থেকে দিনরাত অবিরাম তোলা হচ্ছে পানি। এতে ঢাকায় পানির স্তর প্রতি বছর নেমে যাচ্ছে গড়ে প্রায় পাঁচ ফুট করে। বাড়ছে পানি তোলার খরচও। অর্থাৎ, ১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, এক যুগ আগেও ঢাকায় পানি সরবরাহে বেশ ঘাটতি ছিল। তখন দিনে পানি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৮৮ কোটি লিটার। পরে পানি সরবরাহ দ্রুত ও বহুমুখী করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় ওয়াসা। এই পদক্ষেপে তারা গভীর নলকূপ স্থাপনে বেশি গুরুত্ব দেয়। এখন নগরে গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬টি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় (জোন-১) ৮১টি, পুরান ঢাকায় (জোন-২) ৭০টি, ধানমন্ডি এলাকায় (জোন-৩) ১৩৭টি, মিরপুর-১ (জোন-৪) ১১৫টি, গুলশান–মহাখালীতে (জোন-৫) ৭৭টি, ফকিরাপুলে (জোন-৬) ১১৮টি, শনির আখড়া, মাতুয়াইলে (জোন-৭) ৫৬টি, বাড্ডায় (জোন-৮) ৭৩টি, উত্তরায় (জোন-৯) ৭৫টি, মিরপুর ১০ (জোন-১০) ১০৪টি। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত ২০টি নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে সাভারের ভাকুর্তায় ৫৭২ কোটি টাকা খরচ করে একসঙ্গে ৪৬টি গভীর নলকূপ বসায় ঢাকা ওয়াসা। এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এখন ১৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে সক্ষম এই প্রকল্পের পানি ঢাকার মিরপুরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। ফলে মিরপুর এলাকায় পানি সংকট তীব্র হয়েছে।
মহাখালী, বনানী, গুলশান ঢাকা ওয়াসার জোন-৫ এর আওতাধীন। ২০১৯ সালে এই এলাকাগুলোতে পানির তীব্র সংকট ছিল। তখন এই জোনের বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আটটি নতুন নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন দেয় ওয়াসা। এর মধ্যে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) সংলগ্ন মন্দির গলিতে একটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই কূপ থেকে আড়াই হাজার গ্রাহককে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু দিনে কী পরিমাণ পানি এই পাম্প থেকে ওঠানো হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
জোন-৫ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ তৌহিদ এলাহী। তিনি জানান, তার জোনে প্রায় ১৪ হাজার গ্রাহক। তাদের নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ করতে ওয়াসার নলকূপ রয়েছে ৭৭টি। গ্রাহকদের বাসাবাড়ি বা অফিসে যে পানি সরবরাহ করা হয় তার ৮০ শতাংশই নলকূপের। বাকি ২০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থের।
ওয়াসা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডের বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করে। ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, এই ওয়ার্ডগুলোতে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। সেখানে গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের বেশি। তাদের পানির চাহিদা মেটাতে দিনে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। এর মধ্যে শতকরা ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ৬৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। তবে সিস্টেম লসের (অপচয়) কারণে দিনে প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত যায় না। এতে শহরে পানির ঘাটতি থাকছেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের বিভিন্ন এলাকার এক হাজার ২৭২টি কূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন পানি পাওয়া যেত সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে।
গত ৫ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নগরবাসীর চাহিদা ও ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা’ শীর্ষক একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপে ঢাকা ওয়াসার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড লিখিতভাবে জানানো হয়। পরে যোগাযোগ করা হলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম এ খান জাগো নিউজকে বলেন, ২০২৩ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহ করা পানির ৭০ শতাংশ আসবে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ। এভাবেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ বা নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। এটি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে।
ভূর্গভস্থ পানি অফুরন্ত নয় জানিয়ে ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ঢাকা শহরে বিপজ্জনভাবে ভূর্গভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। ওয়াসাকে নদীর পানি ব্যবহারের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৃষ্টির পানি সবচেয়ে বিশুদ্ধ। এটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
তিনি বলেন, এখন কলকারখানার বর্জ্যের কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হ্রদ, পুকুর, ঝরনা, প্রভৃতির পানি (সার্ফেস ওয়াটার) দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গাজীপুরের কলকারখানা থেকে সার্ফেস ওয়াটারে দূষণ বেশি ছড়ায়। এ দূষণের কারণেও পানি দূষিত হচ্ছে এবং স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ওয়ারপো বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, গৃহস্থালি ব্যবহার ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের লাইসেন্স প্রদান, মনিটর করে যথেচ্ছ উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)। কিন্তু গত চার বছরে তেমন কোনো কার্যক্রম জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে পারেনি সংস্থাটি।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) মহাপরিচালক মো. দেলওয়ার হোসেন ব্যস্ততার কারণে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পানিসম্পদ) মো. আমিনুল হকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে যোগাযোগ করা হলে আমিনুল হক বলেন, ওয়াসা কত ফুট গভীরে নলকূপ বসাবে তা আমরা নির্ধারণ করে দেই। এর বাইরে ওয়ারপোর সঙ্গে ওয়াসার তেমন কাজ নেই। তবে ভূগর্ভস্থে কী পরিমাণ পানি আছে, কতটুকু পানি উত্তোলন করা যাবে বা নলকূপ কী পরিমাণ গভীর হবে তা গবেষণার বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে পানিসম্পদ নিয়ে আগে সমন্বিতভাবে কোনো গবেষণা হয়নি। বিভিন্ন সংস্থা তাদের নিজেদের মতো করে গবেষণা করেছে। তাই ঢাকাসহ সারা দেশে ভূর্গভস্থ পানির অবস্থান জানতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে পরবর্তীসময়ে পরিকল্পনামাফিক কাজ করবে ওয়ারপো।
ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ধীরগতি
মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। এখন এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। শোধনাগার ও পানির লাইনের নির্মাণকাজ শেষে কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে সেটি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে নিতে সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি ওয়াসা। এতে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না ওয়াসা।
জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, ঢাকা শহরে চাহিদার ৮০ শতাংশ পানি ভূর্গভস্থ থেকে মেটায় ওয়াসা। এতে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে কমতে থাকলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পদ্মা নদী থেকে ঢাকায় পানি সাপ্লাই দেওয়ার যে প্রকল্পের কাজ চলছে, তা শেষ করতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।