বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
করোনা মহামারির মধ্যে একটি বেসরকারি কোম্পানি থেকে চাকরি হারান রংপুরের হাসান। দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে চার সদস্যের সংসার তার। চাকরি হারানোর পর পরিবারের অন্ন জোগাতে বাধ্য হয়েই শুরু করেন সবজির ব্যবসা। তবে পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকায় সে ব্যবসাও টেকেনি বেশিদিন। এরপর একটি নির্মাণাধীন ভবনে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইচএসসি পাস হাসান অল্পদিনেই মিস্ত্রি হয়ে ওঠেন। এসময় খাবারের বিলসহ প্রতিদিন তার আয় ছিল ৭শ টাকা। এ টাকায় চার সদস্যের সংসার বেশ ভালোই চলছিল। কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামে ছোট একটি বাড়িও করেন। সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল। তবে তার সাজানো সংসারে হঠাৎ নেমে এলো কালো মেঘ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই দেশের বাজারে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। যে ভবন নির্মাণে কাজ করছিলেন হাসান, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় সেটি আর চালিয়ে যেতে পারেননি ভবন মালিক। ফলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আর কাজও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সংসার চালাতে আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর চিন্তায় দিশেহারা তিনি। অন্যদিকে যত দিন গড়াচ্ছে ততই নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে ঋণের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এ শহর ছেড়েই চলে যেতে হবে তাকে।
কাজ বন্ধ থাকায় আমাদের পথে বসার উপক্রম। দু’একটি কাজ থাকলেও মজুরি কম। আগে যেখানে দিনে ৭০০ টাকা পেতাম, এখন সেটা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় করতে হয়। এ কাজও আবার অনিয়মিত
একই কথা বলেন টাইলস মিস্ত্রি ও হাসানের বড় ভাই হামিদ। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে রডের দাম বাড়ায় দেশীয় কোম্পানিগুলো অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়িয়েছে। এতে লোকসানের আশঙ্কায় আবাসন কোম্পানিগুলো আপাতত কাজ বন্ধ রেখেছে। কবে আবার কাজ পুরোদমে চলবে কি না জানি না। দু’একটি কাজ থাকলেও মজুরি কম। আগে যেখানে দিনে ৭শ টাকা পেতাম, এখন সেটা ৩শ থেকে ৩৫০ টাকায় করতে হয়। এ কাজও আবার অনিয়মিত।
‘কাজ বন্ধ থাকায় আমাদের পথে বসার উপক্রম। কখনো কারও কাছে হাত পাতিনি। কিন্তু এখন কাজ না থাকায় হাতে পয়সা নেই। বাধ্য হয়ে টিসিবির ট্রাকের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পরিবারের জন্য পণ্য কিনি।’
এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন নির্মাণশ্রমিকরা। সীমিত আকারে হলেও এসব শ্রমিকদের সহযোগিতা করা দরকার। প্রয়োজনে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেটা পরিশোধযোগ্য। আবাসন শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে এমন প্রস্তাব দিতে পারেন, যাতে আর্থিক সহায়তা পান তারা।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের অভুক্ত রেখে কোনো খাত চলতে পারে না। নিম্ন আয়ের মানুষ ও শ্রমিকদের সবাই যেন নিত্যপণ্য পান- এটা সরকারকে দেখতে হবে। তারা (শ্রমিকরা) টিসিবির রেশন কার্ড যেন পান এটা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানে দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম এ যাবতকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতি টন রডে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি টন রড ৯০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে রেকর্ডদামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্ট। এছাড়াও মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে ভবন নির্মাণে প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণের দাম। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ইট, খোয়া ও বালি।
নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় চালু থাকা প্রকল্পের কাজ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে বলেও জানান নির্মাণশিল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের শঙ্কা, লাফিয়ে লাফিয়ে নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে ন্যূনতম ৮শ থেকে এক হাজার টাকা বা তারও বেশি বাড়তে পারে। পাশাপাশি আবাসনের সঙ্গে জড়িত ২৬৯টি খাতের ৩৫ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
দেশের বাজারে নির্মাণসামগ্রীর দাম ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় থমকে গেছে নির্মাণকাজ। আবাসনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি। আবাসন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগও আটকে গেছে। আর সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় ছোট আবাসন কোম্পানিগুলো তাদের রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি করছে না। আরও কিছুদিন বাজার পরিস্থিতি দেখে হয়তো বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবে তারা। অন্য বড় কোম্পানিগুলোর রেডি প্রকল্পেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। ক্রেতাদের একটা বড় অংশই ভাবছেন, সবকিছুর দাম সাধ্যের মধ্যে হলেই কিনবেন।
এদিকে, রড-সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ (পিডব্লিউডি) সব দপ্তরের রেট শিডিউল হালনাগাদের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি (বিএসিআই)। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি শেখ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ মালের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে রডের দাম প্রতি টনে ৬১ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া সিমেন্টের দাম প্রতি ব্যাগে ২২ শতাংশ, পাথর প্রতি ঘনফুটে ২৪ শতাংশ, ইট প্রতি হাজারে ২২ শতাংশ, মোটা বালু প্রতি ঘনফুটে ৫০ শতাংশ, বিটুমিন প্রতি টনে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে ইলেকট্রিক ক্যাবলের (১.৫ বিওয়াইএ) দাম বেড়েছে ৯৪ শতাংশ। এ অবস্থায় সরকারি চলমান প্রকল্পে দাম সমন্বয় করা না হলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের পুঁজি হারাতে হবে।
এ বিষয়ে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) দপ্তর সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, দেশের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক কন্সট্রাকশনের কাজ বন্ধ রয়েছে। আর কাজ বন্ধ থাকায় দেশের ৪০ লাখ ইমারত নির্মাণশ্রমিকের মধ্যে এখন বেশিরভাগ শ্রমিকই বেকার। যারা কাজ করছেন, তাদের মজুরিও কমেছে। এ অবস্থা সাময়িক হলেও শ্রমিকদের সহযোগিতা করতে হবে মালিকপক্ষেকে। একই সঙ্গে সরকারও এসব শ্রমিকদের জন্য সাময়িক অর্থসহায়তা (ফেরতযোগ্য লোন) দিতে পারে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অনেকটা থমকে গেছে নির্মাণকাজ। লাফিয়ে লাফিয়ে রড, সিমেন্ট, ইট-বালিসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে নির্দিষ্ট মূল্যের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। ব্যয় বাড়লে এর প্রভাব ক্রেতার ওপরও পড়ে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে ন্যূনতম ৮শ থেকে ১১শ টাকা বাড়তে পারে।
‘আবাসনের সঙ্গে জড়িত ২৬৯ প্রকার লিংকেজ শিল্প প্রসারের মাধ্যমে সমগ্র নির্মাণখাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সব পণ্যের দামতো আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়েনি। অথচ আমাদের দেশে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল ৪০ লাখ শ্রমিক মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের নিজ নিজ কোম্পানি সহযোগিতা করছে।’
তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবারও আবাসন ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ ব্যবসায়ী।