বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
দেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরাসহ পার্বত্য জেলায় এখন বেশ মানসম্মত আম উৎপাদন হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে এসব জেলার দূরত্ব অনেক। পরিবহন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ নানান কারণে প্রতিবছর তাই উৎপাদিত আমের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। নষ্ট রোধ করে বিদেশে বাড়তি আম রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তবে বেশ কিছু ব্যয় কাটছাঁট করে অনুমোদন করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে ডিএই। অধিক আম উৎপাদন হয় এমন জেলার যে সব কৃষকের ৫০ শতকের বেশি কৃষিজমিতে আম বাগান রয়েছে তাদের উপকারভোগী কৃষক হিসেবে বাছাই করা হবে। রপ্তানিমুখী বাজার সংযোগ স্থাপন প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। আম যায় ইংল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও হংকংয়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বছরে দেশে এক লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে নষ্ট হয় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় পাঁচ শতাংশ আমের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষাসহ বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন বাড়ানো হবে। এতে রপ্তানি বাড়বে দ্বিগুণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও প্রকল্পের ফোকাল পারসন মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় যে সব কৃষকের ৫০ শতকের বেশি কৃষিজমিতে আম বাগান রয়েছে তাদের উপকারভোগী কৃষক হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। মানসম্মত আম উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি আয়ও বাড়ানো হবে। দেশে এক লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমের উৎপাদন আরও বাড়ানো হবে। প্যাকেজিং, আম ব্র্যান্ডিং, ওয়াশিংসহ সব ধরনের সুবিধা পাবেন কৃষক। আমাদের মূল লক্ষ্য আম নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে বিদেশে রপ্তানি বাড়ানো।
ডিএই জানায়, প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত দেশের চারটি বিভাগের ১৫টি জেলার ৪৬টি উপজেলা। রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া, তানোর, মোহনপুর, নওগাঁর বদলগাছি, সাপাহার, পোরসা, মান্দা, নাটোর সদর, বড়াইগ্রাম, বাগাতিপাড়া, লালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর, শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, রাঙ্গামাটি সদর, নানিয়ারচর, বরকল, বান্দরবান সদর, দিঘীনালায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এছাড়া তালিকায় আরও রয়েছে খাগড়াছড়ি সদর, দিঘীনালা, রংপুরের সদর, পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ, যশোরের সদর, মনিরামপুর, শার্শা, সাতক্ষীরার কলারোয়া, দেবহাটা, কুষ্টিয়ার মিরপুর, দৌলতপুর, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা ও মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানসম্মত আমের বর্তমান অবস্থা থেকে পাঁচ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানো, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বাড়ানো ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন। মানসম্মত আম উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে কৃষক, কর্মকর্তা এবং সুবিধাভোগী (স্টেকহোল্ডার) জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বাড়ানো হবে।
নানান কারণে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। ডিএই জানায়, আম পুষ্টিকর ফল। অতুলনীয় স্বাদের জন্য একে ফলের রাজা বলা হয়। বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বাংলাদেশে প্রায় ৭২ জাতের আম উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে জনপ্রিয় জাতগুলো হলো- খিরসাপাত, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, হাড়িভাঙা ও আম্রপালি। বাংলাদেশে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমের সরবরাহ থাকে। সামগ্রিক বিবেচনায় পুষ্টিকর, সুস্বাদু আম আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ ও উচ্চ মানসম্মত আম উৎপাদন করা সম্ভব হলে দেশের রপ্তানি আয় বাড়বে। পাশাপাশি করোনাকালীন গ্রামে ফেরা মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবিত মূল কার্যক্রম
উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে আম উৎপাদনে ২ হাজার ৩০০টি প্রদর্শনী, ২ হাজার ৩০০টি রপ্তানিযোগ্য জাতের আম বাগান সৃজন, বিদ্যমান ১ হাজার ৮৪০টি আম বাগানে সার ও বালাই ব্যবস্থাপনা করা এবং ১ হাজার ৮৪০টি বাগানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার (ব্যাগিং ও বালাই ব্যবস্থাপনা) করে মানসম্মত আম উৎপাদন। ৯২০ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ, রপ্তানিকারক, বাজারজাতকারী ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার প্রশিক্ষণ, আম পরিবহন, কার্গো ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের প্রশিক্ষণ, কৃষি অফিসার্স প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, পাঁচটি ম্যাংগো গ্লোডিং, ক্লিনিং ও কুলিং শেড নির্মাণ, ৯২০টি ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও সরবরাহ, চারটি হাইড্রোলিক ম্যাংগো হারভেস্টার, ৪৬টি গার্ডেন টিলার, ৯২০টি ফুট পাম্প, ৪৬০টি পাম্প ও ৪৬০ সেটা ফিতা পাইপ কেনা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে অধিদপ্তর। কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খানের সভাপতিত্বে গত ৬ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। কমিশনের মতামত দিয়ে প্রকল্পটি পরিমল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দফতরে পাঠানো হয়েছে। ডিএই যা প্রস্তাব করেছিল তা কিছুটা কাটছাঁট করা হয়।
কমিশন জানায়, শ্রমিক মজুরি, বেজ লাইন সার্ভে, প্রোগ্রেস মনিটরিং, সমাপনী মূল্যায়ন, ডেস্কটপ কম্পিউটার ও প্রিন্টার, লেজার কালার প্রিন্টার, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, অফিস সরঞ্জামাদি, ল্যান্ড ফোন (আবাসিকসহ), আইপিএসসহ খাতের সংস্থান প্রকল্পে অযৌক্তিকভাবে রাখা হয়েছে। এগুলো প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পের ২০ জন কর্মকর্তাকে দুই ব্যাচে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/শিক্ষা সফরের জন্য মোট ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম উৎপাদন, প্যাকেজিং এবং রপ্তানি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে মোট ১০ জন কর্মকর্তার বৈদেশিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ খাতে ব্যয়ও কমবে অর্ধেক।
প্রকল্প দলিলে প্রস্তাবিত ভ্রমণ ব্যয়, অন্যান্য মনিহারি (স্টেশনারি ), ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রদর্শনী এবং কৃষিপ্রযুক্তির তথ্য আদান-প্রদান ও সংরক্ষণ, ফটোকপিয়ার, স্ক্যানার মেশিন খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন।
এছাড়া প্রস্তাবিত মুদ্রণ ও বাঁধাই খাতে ১৫ লাখের পরিবর্তে ৫ লাখ, এয়ারকন্ডিশনার পাঁচটির পরিবর্তে দুটি, আসবাবপত্র খাতে ৮ লাখ টাকার পরিবর্তে দুই লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশীয় পরামর্শক (আম উৎপাদন ও কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ) খাতে একজনের জন্য ৯০ লাখ টাকার সংস্থান রাখার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
এছাড়া প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২৫ কোটি টাকার বেশি হওয়ায় সেন্টার ফর রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিস সি (সিআরডিএস), আম গবেষণা কেন্দ্র ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা খান জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের প্রস্তাবনা আমাদের হাতে এসেছে। আমরা পিইসি সভা করেছি। প্রকল্পের বিষয়ে আমাদের কিছু পযর্বেক্ষণ দিয়েছি। আমাদের পযর্বেক্ষণ সঠিকভাবে প্রতিপালন করেছে ডিএই। সেই মোতাবেক আমরা প্রকল্পটি অনুমোদন করেছি।
প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিদেশে আম রপ্তানির অন্যতম সমস্যা আমরা কোয়ালিটিফুল আম উৎপাদন করতে পারি না। আমের মুকুল আসার পর থেকে কীভাবে এটা সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং করা যায় সে বিষয়ে কৃষকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হবে। ফলে বিদেশে মানসম্মত আম রপ্তানি করতে পারবো।