বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারপতির সংখ্যা এখন ৮৬ জন। তাদের মধ্যে ৫২ বেঞ্চে দায়িত্ব পালন করছেন ৮১ জন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাজ করছেন। অসদাচরণের দায়ে বিচারিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে বাকি দুজনকে। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে আছেন ছয় বিচারপতি। একযুগ আগে (২০০৯ সালে) এ সংখ্যা ছিল ১১ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং বিচারিক (নিম্ন) আদালত, সবখানেই বাড়ছে মামলার সংখ্যা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মামলা জট। মামলার অনুপাতে বিচারক না বাড়ায় বহু মামলা ঝুলে আছে। অবসরে যাওয়া বিচারকদের শূন্যস্থানে সময়মতো নতুন বিচারক নিয়োগ না হওয়া এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগের ফলে এই বিভাগেও বিচারপতি কমছে।
এ অবস্থায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে জানা যায়।
বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা বলছেন, সব আদালতে যে হারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। এ অবস্থায় মামলা জট কমাতে ও বিচার কার্যক্রম গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় বিচারক নিয়োগের বিষয়টিতে এখনই জোর দেওয়া জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এখন চলছে নতুন বিচারপতি নিয়োগের তোড়জোড়। এ লক্ষ্যে ‘নিয়োগযোগ্য’ ব্যক্তিদের নাম এখন বিবেচনার টেবিলে। কাদের নাম আছে তালিকায়, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নাকি আইনজীবী, এ নিয়ে বিচারঙ্গনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
জানা যায়, কর্মরত বিচারপতিদের মধ্যে ১৭ জন নিযুক্ত হয়েছেন জুডিশিয়াল সার্ভিস (জেলা জজ) থেকে। বাকি ৬৯ জনই নিয়োগ পেয়েছেন আইনজীবীদের মধ্য থেকে। যা জুডিশিয়াল সার্ভিসের চারগুণ বেশি।
সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা নির্ধারণ এবং নিয়োগ দেন।
সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি (যিনি ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত হইবেন) এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যে সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনবোধ করবেন, সেই সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হইবে।’
সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। বিচারপতি নিয়োগের ‘যোগ্যতা’র বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। তবে ‘অযোগ্যতা’র বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে।
সংবিধানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে, সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বছর অ্যাডভোকেট না থাকলে অথবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বছরর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে অথবা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারকপদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা চাচ্ছেন দক্ষ, সৎ ও আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ- এমন ব্যক্তিদের যেন বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একজন দক্ষ বিচারপতির বিকল্প নেই।
বিচারক সংকট ও নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, সিনিয়র আইনজীবী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি সংকট রয়েছে। জরুরিভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, এখন তো বিচারপতি অনেক, মানুষের সমস্যাও বেশি। তবে কাজের লোক কম হলেও খুব ভালো কাজ করা লোক দরকার। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির জন্য ভালো বিচারপতি দরকার। মামলা যে হারে বাড়ছে, বিচারপতিও কিন্তু কম না। কিন্তু দেখতে হবে নিষ্পত্তি কত।
সাবেক এই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের অনেক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। সে কারণে বলছি, মামলা হ্রাস-বৃদ্ধি বিচারপতির দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। ফলে দেখে-শুনে ভালো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। আবার অনেকে অবসরে চলে গেছেন, তাই বিচারপতির সংখ্যা কমেছে। আশা করি দ্রুতই বিচারপতি নিয়োগ দেবে সরকার।
হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, হাইকোর্টে আরও অনেক বিচারপতি নিয়োগ করা উচিত। মামলার জট যেভাবে বাড়ছে তাতে আমার মনে হয় শিগগির অনেক বিচারপতি নিয়োগ করা উচিত। আর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। আমি মনে করি, দক্ষতা-যোগ্যতার ভিত্তিতে যেন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, সেটাই আমাদের কাম্য। কিন্তু দলীয় নীতিতে যদি বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা নিয়োগ হবে, ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকবে না। আমরা বহুদিন থেকেই দাবি করে আসছি, বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা হোক।
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম মনির জাগো নিউজকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এখন বিচারপতি কম আছে। নিয়োগ হলে হয়তো মার্চেই হয়ে যেতে পারে।
এ নিয়ে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন জাগো নিউজকে বলেন, বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে দেশের প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী পরামর্শ করবেন। হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে আমার সঙ্গে কারো কথা হয়নি। কথা হলে বলতে পারবো কবে, কতজন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
বিচারক সংকট ও নতুন নিয়োগ নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তারপরও এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবো। আশা করছি, খুব শিগগির নিয়োগ দেওয়া হবে।