বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
অধিকাংশ সূচকে অনেক আগেই দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। পিছিয়ে ছিল কেবল আমানতের দিক থেকে। এতদিন দেশের সবচেয়ে বেশি আমানত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের হাতে। কিন্তু বিদায়ী বছর শেষে ইসলামী ব্যাংকের কাছে আমানতের শীর্ষস্থান হারিয়েছে সোনালী ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকের আমানত সোনালী ব্যাংকের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর বেসরকারি খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত থাকা পূবালী ব্যাংকের চেয়ে এটি তিন গুণ।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত এখন ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা
ইসলামী ব্যাংকের আমানতে বড় উল্লম্ফনের সূচনা করোনাকালের শুরুতে। গত দুই বছরেই ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর গত চার বছরে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৬৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১৮ সালের শুরুতে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে এ আমানত ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
দেশে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশী খাতের এত ব্যাংক থাকতে আমানতকারীরা কেন ইসলামী ব্যাংককে ছুটছেন? তার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে বণিক বার্তা। এ নিয়ে কথা বলা হয় ব্যাংকটির গ্রাহক, কর্মকর্তা, শীর্ষ নির্বাহীসহ দেশের ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্য হলো দেশের ব্যাংক খাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার পেছনে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সততার পাশাপাশি পেশাদারিত্বের প্রশংসাই করছেন সবাই। এর পাশাপাশি ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাও ব্যাংকটিকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন তারা।
কর্মীদের পাশাপাশি গ্রাহকরাও ইসলামী ব্যাংকের অ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওল বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা নিজেদের পেশাকে ইবাদত মনে করেন। আমাদের কর্মীদের সততা, আত্মোৎসর্গের মানসিকতা ও পেশাদারিত্ব এ ব্যাংককে দেশের মানুষের হূদয়ে জায়গা করে দিতে সহযোগিতা করেছে। তবে ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরাই হলো মূল সম্পদ। আমাদের অনেক গ্রাহক আছেন, যাদের দেশের অন্য কোনো ব্যাংকে হিসাব পর্যন্ত নেই। ৩৯ বছর ধরে শুধু ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছেন, এ ধরনের গ্রাহকও আমাদের রয়েছে। গ্রাহকরা ব্যাংকের শুভেচ্ছাদূতের ভূমিকা রাখছে। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
অন্য সূচকগুলোতে পিছিয়ে থাকলেও এতদিন দেশের সবচেয়ে বেশি আমানত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছে। তবে ২০২১ সালে আমানতের শীর্ষস্থানও হারিয়েছে ব্যাংকটি। গত বছর শেষে সোনালী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ আমানতের অন্তত ৪০ শতাংশ সরকারি খাতের। সোনালীর পাশাপাশি দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ আমানতের ব্যাংক হলো রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের জনতা। ২০২১ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৭০০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা আমানত আছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের হাতে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান এ চার ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় অর্ধেক সরকারি খাতের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিকানা সরকারের। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ব্যাংকগুলোর শাখা রয়েছে। এ কারণে সেবার মান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না থাকলেও গ্রাহকরা এ খাতের ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখছেন। অন্যদিকে সরকারি আমানতের বড় অংশ জমা থাকছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। কিন্তু শুধু বেসরকারি আমানতে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোকে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ গ্রাহকদের অন্যরকম আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, কোনো এলাকায় অন্য ব্যাংকের একটি নতুন শাখা খুললে যে পরিমাণ আমানত জমা হয়, ইসলামী ব্যাংকে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি জমা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা ইসলামী ব্যাংকের হিসাব খুলে এবং ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একটি ব্যাংকের জন্য এ ধরনের আস্থা ও ভাবমূর্তি অর্জন করা বিরাট ব্যাপার।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের দিক থেকে সোনালী ব্যাংক ভালো অবস্থানে থাকলেও ঋণ বাড়াতে পারেনি। সোনালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে বড় ঋণ দিতে গিয়ে কেলেঙ্কারিও তৈরি করেছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও ব্যাংকটির কোনো তহবিল তসরুপের খবর পাওয়া যায়নি। এ কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাংকটিতে টাকা রাখতে উৎসাহ বোধ করে। তবে ভবিষ্যতেও ইসলামী ব্যাংক ঘিরে যেন কোনো বিপদ তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ব্যাংকটি দেশের অর্থনীতির জন্য সম্পদ হয়ে উঠুক।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত এখন ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা
ইসলামী ব্যাংকের পর দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত আছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে পূবালী ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকের আমানত তিন গুণেরও বেশি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত আছে মাত্র চারটি ব্যাংকের। পূবালী ছাড়াও এ তালিকায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মতোই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাখা আছে পূবালী ব্যাংকের। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিউল আলম খান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পূবালী ব্যাংক ২০ বছর ধরেই ধারাবাহিক উন্নতির পথে রয়েছে। তবে ইসলামী ব্যাংকের উন্নতি অভূতপূর্ব। ইসলামী ধারার ব্যাংকের প্রতি মানুষের দুর্বলতা, ভালো ব্যবস্থাপনা ও একদল সৎ কর্মী বাহিনীর কারণে ব্যাংকটি এ সাফল্য পেয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, দেশের বাইরেও ব্যাংকটির সফলতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আমদানি হয়েছে ৬৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার পণ্য। একই সময়ে দেশ থেকে ৩০ হাজার ১৭৮ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে ব্যাংকটির মাধ্যমে। পাশাপাশি ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংক প্রবাসীদের পাঠানো ৫০ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছে। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরে ব্যাংকটির বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত ৮০ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকে আমানতকারী গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৬২ লাখ। একই সঙ্গে ১৮ লাখ গ্রাহকের কাছে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ রয়েছে। সারা দেশে ৩৭৪টি শাখা, ২০০টি উপশাখা, ২ হাজার ৫০০ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও প্রায় ২ হাজার এটিএম ও সিআরএম বুথ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের।
সুত্রঃ বণিক বার্তা