শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

“ফ্রি পিস অ্যাওয়ার্ড ২০২১” পেলেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম”

সাহসী সাংবাদিকতার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম, যিনি বাংলাদেশে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম তুলে ধরতে গিয়ে নিগ্রহ, নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়েছেন। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থা ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড তাঁকে এ বছরের ‘ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড-২০২১’ দিয়েছে। তিনি পুরস্কারটি পেয়েছেন সেরা অদম্য সাংবাদিক বা মোস্ট রেজিলিয়েন্ট জার্নালিস্ট শ্রেণিতে।”ফ্রি পিস অ্যাওয়ার্ড ২০২১” পেলেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম”

মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করা সাংবাদিকদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়। গত বছর একই পুরস্কার পেয়েছিলেন এ বছর শান্তিতে নোবেল পাওয়া ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার উৎকর্ষের জন্য বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে কাজ করে ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড। বিশ্বব্যাপী ৯০টির বেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের। সংস্থাটিকে সহায়তা করে নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের সিটি হলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত সোয়া ১২টা) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মীরের হাত থেকে রোজিনা ইসলামের পক্ষে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন তাঁর স্বামী মো. মনিরুল ইসলাম। রোজিনা ইসলামের পাসপোর্ট জব্দ থাকায় তিনি পুরস্কারটি নিতে নেদারল্যান্ডস যেতে পারেননি।

নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের সিটি হলে অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন রোজিনা ইসলামের স্বামী মনিরুল ইসলাম, ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন রোজিনা ইসলাম।
তবে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই পুরস্কার দেশের সেসব সাংবাদিককে উৎসর্গ করছি, যাঁরা প্রতিকূলতার মধ্যেও সেরা সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘কারাগার থেকে বেরিয়ে আমি বলেছিলাম, সাংবাদিকতা চালিয়ে যাব। এই পুরস্কার পাওয়ার পর আমি আবারও বলছি, আমার লড়াই চলবে।’

ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড দুটি শ্রেণিতে ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকে—সেরা অদম্য সাংবাদিক বা মোস্ট রেজিলিয়েন্ট জার্নালিস্ট এবং বছরের সেরা নবাগত সাংবাদিক বা ‘নিউ কামার অব দ্য ইয়ার’। সাংবাদিক রোজিনা পুরস্কারটি পান সবচেয়ে অদম্য সাংবাদিক শ্রেণিতে। বছরের সেরা নবাগত শ্রেণিতে পুরস্কার পেয়েছেন ভারতের তরুণ সাংবাদিক ভাট বুরহান।

সাংবাদিকতায় রোজিনা ইসলামের সাহসিকতা ও নিরলস প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড বলেছে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন রোজিনা ইসলাম। তিনি করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম প্রকাশ্যে এনেছেন। এখন নিজের দেশে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেতে হচ্ছে হয়রানির মধ্য দিয়ে।

বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের প্রখ্যাত টিভি সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা হেন্নাহ দ্রাইবার, পাকিস্তানে মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ওয়াইস ইসলাম আলী এবং নেদারল্যান্ডসের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ডাচ–ফ্লেমিস অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের সাবেক পরিচালক তানজা ফন বেরগেন।

বিচারকমণ্ডলীর সবাই একমত হয়ে রোজিনা ইসলামকে সেরা অদম্য সাংবাদিক হিসেবে মনোনীত করেন। তাঁরা বলেন, ‘মহামারির এই সংকটময় সময়ে অনিয়ম বের করে আনতে সাংবাদিকের লড়াইয়ের সঙ্গে আমরা সংহতি প্রকাশ করছি। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রোজিনা ইসলামকে হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

রোজিনা ইসলাম
রোজিনা ইসলামছবি: আশরাফুল আলম
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গত ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন। তাঁকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে তাঁকে শতবছরের পুরোনো ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে’ গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

রোজিনা ইসলাম পাঁচ দিন পর জামিনে মুক্ত হন। তাঁকে নির্যাতন ও মামলার প্রতিবাদে দেশে-বিদেশে কর্মসূচি পালিত হয়। বিভিন্ন দেশীয় ও বৈশ্বিক সংস্থা প্রতিবাদ জানায়। জামিনে মুক্তি পেলেও এখনো রোজিনার মামলা তুলে নেওয়া হয়নি। পাসপোর্ট, মুঠোফোন ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সচিবালয়ে প্রবেশের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডও ফেরত পাননি তিনি।

মনোনীত ছিলেন তিনজন
‘মোস্ট রেজিলিয়েন্ট জার্নালিস্ট’ শ্রেণিতে পুরস্কারের জন্য রোজিনা ইসলাম ছাড়াও এ বছর মরক্কোর সাংবাদিক ওমর রাদি ও বেলারুশের সাংবাদিক রামান ভাসিউকোভিচ মনোনীত হয়েছিলেন।

ওমর রাদি এক দশকের বেশি সময় ধরে মরক্কোয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছেন। তিনি দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের পেছনের অনেক কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছেন। ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড বলছে, দীর্ঘদিন হয়রানির পর তাঁকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন কারাবন্দী।

বেলারুশের ‘কারেন্ট টাইম’ টেলিভিশনের সাংবাদিক রামান ভাসিউকোভিচ গত বছর দেশটির নির্বাচনে জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খবর প্রচার করেছিলেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু তারপরও নিজের কাজ থেকে সরে যাননি রামান ভাসিউকোভিচ। তিনি ইউক্রেনে অবস্থান করে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো সরকারের দুর্নীতির খবর প্রচার করে আসছেন।
বছরের সেরা নবাগত শ্রেণিতে পুরস্কার পাওয়া ভাট বুরহান ভারতের নয়াদিল্লিভিত্তিক ২২ বছর বয়সী একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি প্রামাণ্যচিত্রে কাশ্মীরে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর দুর্দশা, ভারতের কৃষক আন্দোলন, নয়াদিল্লিতে করোনায় মৃতদের সৎকারে যুক্ত মানুষের অবস্থা ও শহরটিতে আশ্রিতদের করোনার টিকা না পাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।

রোজিনা ইসলামের পাওয়া পুরস্কারের অর্থমূল্য সাড়ে ৭ হাজার ইউরো, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার সমান। সাংবাদিক ভাট বুরহান পেয়েছেন দেড় হাজার ইউরোর (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় লাখ টাকা) বৃত্তি।

পুরস্কার ঘোষণায় ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড আরও বলেছে, ‘এই পুরস্কারের জন্য আমাদের কাছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সাহসী ও মেধাবী সাংবাদিকের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর অবিশ্বাস্য রকমের চাপ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকেরা নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করে তাঁদের পেশার প্রতি যে একাগ্রতা দেখিয়ে চলেছেন, তাতে আমরা অভিভূত।’

‘রোজিনা দমে যাননি’
পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের ওয়েবসাইটে রোজিনা ইসলাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি নানা হুমকি ও হয়রানির মধ্যেও ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি দুর্নীতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে দমে যাননি।

এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রথম আলোতে কর্মরত রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য খাত ছাড়াও স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অপরাধ, পরিবেশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন করেছেন।

ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার আগেও রোজিনা ইসলাম সাংবাদিকতায় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। এ বছর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) স্বাস্থ্য খাতে সেরা প্রতিবেদনের পুরস্কার পান তিনি। এই প্রতিবেদন ছিল স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগে দুর্নীতিসংক্রান্ত। ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৭ সালেও ডিআরইউ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

রোজিনা ইসলাম ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ড (২০১১), ইউনেসকো ক্লাব জার্নালিস্টস অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), প্রথম আলো সেরা প্রতিবেদক পুরস্কার (২০১৩ ও ২০১৪) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারসহ (২০১৫) বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।

ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে রোজিনা ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি অবশ্যই বদলাবে, মানুষের ভালোর জন্য বদলাতে হবে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায়।’

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০