শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত টঙ্গীর পথশিশুরা ।
সর্বনাশা মাদকের ছোবলে যুবক, বয়স্কদের পাশাপাশি টঙ্গীতে ‘ড্যান্ডি’ নেশায় এখন পথশিশুরাও আসক্ত। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জীবনে। এসব শিশুদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের বয়স ৮ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে।
টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়ক, স্টেশন রোড ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশ, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের বাউন্ডারি দেয়াল সংলগ্ন ফুটপাত, রেলওয়ে জংশনের প্ল্যাটফর্ম, বাসস্ট্যান্ড ও বস্তির খুপরি ঘরসহ অধিকাংশ ঘনবসতি এলাকায় ২০-২৫ জন পথশিশুকে প্রকাশ্যে নেশাজাতীয় দ্রব্য ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায়।
কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউবা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। সবার হাতে পলিথিন। ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে নাক মুখ তাতে ঢুকিয়ে কয়েক মিনিট চেপে ধরছে। ভেতরে আঠালো হলুদ কিছু পদার্থ। কিছুক্ষণ গন্ধ শুকার পর একজন ফুটপাতেই চোখ বুজে শুইয়ে আছে, অন্যজন আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কি যেন খুঁজছে। প্রায় প্রতিদিনই কম-বেশি এ দৃশ্য চোখে পড়ে। একই দৃশ্য দেখা যায় নতুনবাজার যাওয়ার পথে সড়কের দুই পাশেও।
নেশার জগতে বিশেষ করে নিম্নবিত্তের কাছে প্রচলিত এ মাদকটির নাম ‘ডেনড্রাইট’। অনেকে ‘বুস্টিক’ হিসেবে চিনে। তবে মাদকসেবীদের কাছে এটি পরিচিত ‘ড্যান্ডি’ নামেই। দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা। এক সময় টোকাই শ্রেণির শিশু-কিশোরদের মধ্যে এর ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে অনেক ধনীর দুলালও এটি গ্রহণ করায় ক্রমশ মাদকসেবীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে এটি।
জানা গেছে, ডেনড্রাইট বা বুস্টিক একধরনের আঠালো পদার্থ। কাঁচ, রাবার, চামড়া কিংবা রেক্সিন জাতীয় বস্তু জোড়া লাগাতে এটি ‘আইকা বা গাম’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্যালন, কৌটা বা টিউবে পাওয়া যায় এটি। যে কোন হার্ডওয়ারের দোকান থেকে এটি খুব সহজেই যে কেউ কিনতে পারে। প্রধানত ভারত ও নেপাল থেকে এটি এদেশে আসছে। ডেনড্রাইট, ড্যান্ডি বা জুতা তৈরির আঠায় ‘টলুইন’ নামক এক ধরনের আঠালো তরল পদার্থ থাকে। এটি বাষ্পীভূত হয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সেবনকারী শিশুদের দেহে প্রবেশ করলে ক্ষণস্থায়ীভাবে ঝিমুনি, মাথাব্যথা, ক্ষুধা না লাগা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার উদ্রেক করে। ডেনড্রাইট স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বুধবার দুপুরে স্টেশনরোড ফুটপাতে গেলে দেখা যায়, ফুটপাতে কয়েকজন বসে ড্যান্ডি সেবন করছিল। এক শিশু পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে নি:শ্বাস টানছে। জিজ্ঞাসা করতেই শুয়ে থাকা শিশুটি চোখ বুজে উত্তর দেয় ‘ড্যান্ডি খাই ড্যান্ডি। এইডা খাইলে নিশা অয়, ঘুম আইয়ে। খিদা লাগে না। দুনিয়াদারির কোন হুঁশ থাহে না।’
নাম জানতে চাইলে একে একে বলে উঠল- নুর মোহাম্মদ, হৃদয়, রিফাত, রাসেল, সূর্য, ময়না, শান্ত।
নেশার টাকা কীভাবে জোগাড় করে জানতে চাইলে হৃদয় জানায়, ভিক্ষা করে টাকা জোগাই আবার বড় ভাইদের নেশা আইন্না দিলে তারা টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়া ড্যান্ডি কিনি। তবে নেশার টাকা জোগাতে পথ যাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাইসহ বাসা-বাড়ি ও দোকানপাটে ছোট-বড় চুরির ঘটনাও ঘটাতে দেখা যায় তাদের।
টঙ্গীতে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা টোকাই উন্নয়ন সোসাইটির অর্গানাইজার অলিউল ইসলাম ভয়ংকর একটি তথ্য দেন। তিনি জানান, ড্যান্ডি সেবনকারী পথশিশুদের অনেকে দাঁতের ফাঁকে ব্লেডের টুকরো ঢুকিয়ে রাখে। মাঝে মধ্যে ব্লেডে চাপ দেয়। এতে মাড়ি কেটে রক্ত বের হয়। ড্যান্ডির গন্ধ শুঁকার পর নোনতা রক্তের স্বাদে নাকি নেশা বেশি হয়।
এ ধরনের বেশ কয়েকজন শিশুকে পেয়েছেন জানিয়ে অলিউল ইসলাম বলেন, অন্য শিশুদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের এখানে রাখা যায় না। আমরা ড্যান্ডিসহ বিভিন্ন নেশা সেবনকারী পথশিশুদের এনে পুনর্বাসনের চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে সরকারী সহায়তা পেলে কাজটি চালিয়ে যেতে আরও সহজ হতো।
এ প্রসঙ্গে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাম জাতীয় কেমিকেল সেবন করলে কিডনি ও লিভার অকার্যকর হতে পারে। এর প্রভাবে ক্রনিক ডিজিজ যেমন ক্যান্সার হতে পারে। এমনকি মস্তিষ্কবিকৃতি হওয়ারও অধিক সম্ভাবনা থাকে।
টঙ্গী সরকারি কলেজের প্রফেসর কানিজ ফাতেমা এসব ড্যান্ডিসেবীদের ভবিষ্যতের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে যুগান্তরকে বলেন, গ্লুগাম বা মাদক হিসেবে পরিচিত ড্যান্ডিতে ‘টলুইন, ন্যাপথালিন, বেনজিন মিথাইল ও কার্বন ড্রাই ক্লোরাইড নামক পদার্থ ব্যবহৃত হয় যা বিশেষ গন্ধযুক্ত, অধিক উদ্বায়ী ও বাষ্পীয়। এটি সেবনে দেহে প্রথমে শিহরণ জাগে এবং পরে অবসন্ন ভাব, চলাফেরায় অসংলগ্নতা, মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব হয়। দীর্ঘমেয়াদি সেবনে লিভার কিডনিসহ ব্রেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে ড্যান্ডি অর্থাৎ টলুইন। এছাড়া নিয়মিত ড্যান্ডি সেবনে বেনজিন মিথাইলের প্রভাবে পথশিশুদের মস্তিষ্ক বিকৃতির আশঙ্কা রয়েছে শতভাগ। এটি সেবনে মানসিক সমস্যা, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এমনকি নার্ভাস সিস্টেম বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। তবে এদের মরণ নেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি ভূমিকার বিকল্প নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।