বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ড. এম. শমশের আলী
মুসলমানরা কেন এত দরিদ্র ও মুসলমানরা জ্ঞান বিজ্ঞানে কেন এত পিছিয়ে? এই দুটি প্রশ্ন অনেক জ্ঞানপিপাসুকে ভাবিয়ে তোলে, অনেকের মনে সন্দেহ জাগে, তাহলে কি ইসলাম ধর্মে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জ্ঞানার্জনকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। এ সন্দেহ নিরসন করতে হলে প্রথমেই বলে রাখা দরকার ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনকে যে কী অপরিসীম গুরুত্ব দান করা হয়েছে, তা কল্পনাই করা যায় না।
কুরআনে প্রথম যে পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়, তারমধ্যে ছিল সর্বপ্রথম পড়ার কথা, তারপর মানব সৃষ্টির (Medical Science) কথা, তারপর কলমের কথা। কিছুকাল বিরতির পর আবার যখন আয়াত নাজিল হলো, তখনও সেই কলমের কথা। অথচ কী দুঃখের কথা যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ কলম ব্যবহার করতে পারে না। কুরআনে এলেম (Science-এর আরবি অনুবাদ এলেম)-এর কথা বলা হয়েছে, বহু জায়গাতে। ইসলাম সাম্যের ধর্ম। কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ সাম্য টেকে না।
কুরআনে বলা হয়েছে, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? আল্লাহ যে এক এবং অদ্বিতীয় তার সাক্ষী মানা হয়েছে জ্ঞানী ব্যক্তিকে। বলা হয়েছে, জ্ঞানী ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি ভয় করেন। কারণ জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, মহাবিশ্বে জীব ও জড়ের শাসনে যে নিয়মাবলী কাজ করে, তা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল- এই শৃঙ্খলার মধ্যে এতটুকু বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে পরিবেশ হতে পারে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত। জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানী ব্যক্তির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে হাদিসেও।
জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীনে যাও, রাত্রে কিছুক্ষণ জ্ঞানচর্চা সারারাত্রির নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম, জ্ঞানী ব্যক্তির কলমের কালি শহীদের রক্তের চাইতেও মূল্যবান, জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নর ও নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য- এসবও হাদিসেরই কথা।কুরআনে প্রায় ৭৫০ আয়াত রয়েছে, যেগুলো বিজ্ঞানের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। এবং অবাক হতে হয় এটা দেখে যে, কুরআনের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের কোনো সংঘাত নেই, আছে সামঞ্জস্য কুরআনে যেসব ঘটনাকে আয়াত (নির্দেশনাবলী) বা আয়া (এক বচন, মানে নিদর্শন) বলা হয়েছে (যথা মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি, দিবারাত্রির পরিবর্তন, জীবজন্তুর বিস্তার, মেঘমালার বিচরণ ইত্যাদি) সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বৈজ্ঞানিক ঘটনা। এই অর্থে বিজ্ঞান আল্লাহর আয়াত (নির্দেশনাবলী)। বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের কোনো সংঘর্ষ নেই-এই কারণে যে, কুরআনে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, কুরআন হোক বা সত্য সহকারে নাজিল হয়েছে, সৃষ্টির সবকিছুই করা হয়েছে সত্য সহকারে- আর বিজ্ঞানীর কাজও সেই সত্যকে আবিষ্কার করা। কোনো বিজ্ঞানীই কোনো নিয়ম বানান না। বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান নিয়মগুলো আবিষ্কার করেন মাত্র। কুরআনে এ সত্য উদঘাটনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে বারবার।
বলা হয়েছে, ধর্মে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। পরের কথাগুলোও মর্মস্পর্শী: সত্য অসত্য থেকে এত স্পষ্ট যে, জোর জবরদস্তির কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সত্য জোরালো বস্তু, যা বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন আর কুরআন এ সত্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত। Mauraice Bucaille তার লেখা Tha Bible, the Quran, and Science গ্রন্থে লিখেছেন ‘there is not a single verse in the Holy Quran which is assailable from the scientific point of view’ অর্থাৎ কুরআনে এমন একটি আয়াত নেই যাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে ঘায়েল করা যায়। সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘Scientific Indication in the Holy Quran’ এ সত্যকে আরও গভীরভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
অনেকই প্রশ্ন করতে পারেন, কুরআনে বিজ্ঞানের কথা এত আছে, অথচ আমরা তা জানতে পারি না কেন? এর জবাবে বলতে হয় যে, আমাদের গ্রামে-গঞ্জে যেসব ধর্মীয় ব্যক্তি ওয়াজ করেন, তারা কুরআন হাদিস পড়েন ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্ক না থাকার কারণে কুরআনের যেসব আয়াতে বৈজ্ঞানিক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে (যেমন প্রত্যেক ‘বস্তু’ জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে) সেগুলোর অর্থ অনুধাবন করে জনসম্মুখে বলা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যে উদাহরণটি এখানে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ‘বস্তু’ বলা হয়েছে, প্রাণী নয়। প্রাণী যে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে সে কথাও কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে; সেটা বুঝতে সাধারণ মানুষের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু বস্তু (প্রাণহীন) জোড়ায় জোড়ায় তৈরি করা হয়েছে – একথা বোঝা গেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে।
এই শতাব্দীর প্রথমার্ধে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী P. A. M. DIRAC দেখিয়েছেন যে, প্রত্যেক কণার একটি করে প্রতিকণা রয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথে সম্পর্ক না থাকলে শুধু ধর্মে পারদর্শী ব্যক্তিরা এগুলো বুঝতে পারেন না। ওদিকে দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, যারা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় রত, তাদের অনেকেই কুরআন পড়েন না বা কুরআনের অর্থ জানেন না। এক কথায় যারা কুরআন জানেন, তারা বিজ্ঞান জানেন না, আর যারা বিজ্ঞান জানেন, তারা কুরআন জানেন না। ইসলামের অগ্রযাত্রায় একটা বড় সমস্যা কিন্তু সেখানেই। আর ঠিক এ কারণেই জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিদের সামনে আমরা এ কথা তুলে ধরতে পারিনি যে, ইসলাম একটি Scientific ধর্ম – এখানে যে DOs এবং DON’Ts আছে (অর্থাৎ যে সব বিধি-নিষেধ আছে) তার প্রত্যেকটির পেছনে আছে একটা Scietifin bsis বা যুক্তি। এখানে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন বিজ্ঞান না পড়ে কি কেউ ইসলাম ধর্ম চর্চা করলে ব্যর্থ হবেন?
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে যাচাই করার প্রশ্নই ওঠে না। কুরআন হাদিস সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটা প্রত্যেক মুসলমানের বিশ্বাস। তবে বিজ্ঞানের আলোকে কুরআনের আয়াতগুলো অনুধাবন করলে, যার ঈমান নেই, তার ঈমান আল্লাহর ইচ্ছায় আসতে পারে। আবার যার ঈমান একটু কমজোর, তার ঈমান আরও মজবুত হতে পারে। আর ভালো করে বুঝতে পারার একটা আনন্দ তো আছেই।
আমরা এবার গোড়ার প্রশ্নে ফিরে আসি। মুসলমানরা দরিদ্র কেন? জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর কেন? আসলে প্রশ্ন দুটি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। আজকাল আমরা বলছি, The future belongs to knowledge অর্থাৎ জ্ঞান যার যত করায়ত্ব ভবিষ্যৎ কর্তৃত্বও থাকবে তার তত বেশি। কুরআনে বলা হয়েছে, যাকে জ্ঞানদান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। জ্ঞানই কল্যাণ।
ইউরোপ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিল এ সত্য তখন মুসলমানরা ভালো করেই বুঝেছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে উদ্দীপ্ত হয়ে হাজার বছর ধরে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছিল। আজ আরেকবার মুসলমানদের এ সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। কলম (অর্থাৎ জ্ঞান)-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর কালাম (আল্লাহর বাণী) পালন করতে হবে। এক হাতে কালাম ও অন্য হাতে কলম-এ অবস্থায় নিজেদের আনতে পারলে অজ্ঞতা থাকবে না- আর তখন দারিদ্র্যও থাকবে না। জ্ঞানপিপাসুদের প্রশ্ন আরও অনেক আছে। মহাবিশ্বের উদ্ভব হলো কী করে? প্রাণের উদ্ভব ঘটল কী করে? এসব প্রশ্ন কুরআনেও উত্থাপিত হয়েছে এবং যেসব সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে সেগুলো অনেক দিনের সাধনার ফলে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জ্ঞানের শেষ নেই, গবেষণারও শেষ নেই। আর শেষ কথা বলেও কিছু নেই জ্ঞানচর্চার জগতে। তাই কুরআনের সব কথা যদি হালের জ্ঞান দিয়ে বোঝা না যায়, তবে অধৈর্য না হয়ে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, কুরআন মহাজ্ঞানী এক স্রষ্টা প্রতিপালক থেকে অবতীর্ণ, এর সব কথাই সত্যি, জ্ঞানের অগ্রগতি আরও হলে এ সত্য আরও ধরা পড়বে।
হাদিসেও যে বিজ্ঞানের প্রতি ইঙ্গিত আছে এখন সে কথাও জনসাধারণকে ভালো করে জানানো দরকার। আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (দঃ) কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা এমন কী কোনো স্কুলেও পাঠ করেননি। তা হলে তিনি বিজ্ঞানের প্রতি ইঙ্গিত দিলেন কেমন করে? এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আমরা অনুশীলনের মাধ্যমে যে জ্ঞান সংগ্রহ করি, তা হচ্ছে derived knowledge বা সংগৃহীত জ্ঞান। কিন্তু আমাদের নবীজির জ্ঞান ছিল Revealed knowledge অর্থাৎ নাজিলকৃত জ্ঞান। স্বয়ং আল্লাহই ছিলেন তার শিক্ষক। সুরা নাজমে বলা হয়েছে যে নবীজি কোনো মনগড়া কথা বলতেন না, তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছিল ওহী, এবং আল্লাহ তাহাকে শিক্ষাদান করেছিলেন শক্তিশালী জিবরাঈলের (আ.) মারফত। আল্লাহ যেখানে নিজেই নবীজিকে শিক্ষা দিয়েছেন, সেখানে নবীজির উক্তিগুলো যে বিজ্ঞান সম্মত হবে- তাতে আর সন্দেহ কোথায়? নবীজি যেসব কাজ করতে বলেছেন এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন- সেগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে সেগুলো সত্যিই বিজ্ঞান সম্মত। নবীজির জ্ঞান যে সুদূরপ্রসারী এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল, তা কয়েকটি হাদিসের বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।
আবু হুরাইরা থেকে একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, একদিন এক ব্যক্তি নবী করিম (দঃ) এর কাছে এসে বললেন ‘হে আল্লাহর রসুল আমার একটি কালো সন্তান হয়েছে; ওই ব্যক্তি স্বভাবতই কালো রংয়ের সন্তান আশা করেননি। নবীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন ভিন্নতর এক প্রশ্ন- ‘তোমার উট আছে? লোকটি উত্তর দিলেন -জি আছে। উটগুলোর রং কী? নবীজি আবার ও জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি উত্তর দিলেন- লাল রংয়ের। নবীজির পরের প্রশ্ন- সব লাল রংয়ের, একটাও কী ধূসর বর্ণের নেই। এবার লোকটি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা ধূসর বর্ণের উট আছে বটে।
এবার নবীজি লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘অনেক লাল উটের মধ্যে হঠাৎ ধূসর রংয়ের উট এলো কেমন করে? লোকটি উত্তর দিলেন, একটি গুপ্ত বৈশিষ্ট্য এই ধূসর রংটিকে টেনে বার করে এনেছে- এবার নবীজি লোকটিকে বুঝিয়ে দিলেন ‘তোমার সন্তানের কালো রংটিও টেনে বার করে এনেছে একটি গুপ্ত বৈশিষ্ট্য।
প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে এ গুপ্ত বৈশিষ্ট্যকে genetics বা বংশগতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় genetics। ভাবতে অবাক লাগে যে আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে এ হাদিসে নবীজি যে প্রসঙ্গটির অবতারনা করেছিলেন তা ছিল Recessive genes বা সুপ্ত genes এর কথা– যা genetecist তা জানতে পেরেছেন অনেক পরে।
উল্লেখযোগ্য যে মানবদেহের বিভিন্ন traits বা বৈশিষ্ট্যের জন্য এক বা একাধিক gens দায়ী। gens হচ্ছে জীবকোষের মধ্যে অবস্থিত DNA বা Dioxyribo Nucleic Acid নামক যে ‘Master moleculer of life’ বা বংশগতির নীল নকশা নির্ধারক যে অণু রয়েছে, তার অংশবিশেষ যা বিশেষ কয়েকটি Chemical compounds দিয়ে তৈরি। বংশপরানুক্রমে এ gens গুলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে transmitted বা প্রবাহিত হয়, প্রজনন কোষের মারফত। যে সব বাবা মার চোখ কালো, তাদের সন্তানের চোখ কালো হবে- সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কালো চোখের জন্য যে gens গুলো দায়ী, সেগুলো সন্তানের মধ্যে সরাসরি প্রকাশিত হয়- এগুলোকে বলা হয় dominant gens।
এখন বংশগতির কোনো এক পর্যায়ে কোনো এক পূর্বপুরুষের চোখ যদি নীল থেকে থাকে, তবে সেই নীল চোখের জন্য দায়ী gens গুলো সরাসরি প্রকাশিত না হয়ে বেশ কয়েক generation ধরে hidden বা সুপ্ত থাকতে পারে এবং হঠাৎ কালো চোখ ওয়ালা বাবা এবং কালো চোখ ওয়ালা মার সন্তানের মধ্যে সেই পূর্বপুরুষের নীল চোখের জন্য দায়ী gens গুলো যেগুলো এতকাল সুপ্ত ছিল, সেগুলো যদি হঠাৎ করে প্রকাশ পায়- তবে বাবা মার চোখ কালো হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের চোখ নীল হতে পারে এবং তা মাঝে মাঝে হতেও দেখা যায়।
বাবা-মার গায়ের রং সাদা হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের রং কালো হতে পারে এবং সেটি ঠিক এ কারণেই। ভাবতে অবাক লাগে যে dominant gens এবং recessives gens গুলো আমরা ভালো করে জানতে পেরেছি এই মাত্র সেদিন, আর আমাদের মহাজ্ঞানী নবী সেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন কত শত বছর আগে। নবীর হাদিসটিতে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়- তা হচ্ছে উটের বৈশিষ্ট্যের সাথে মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলনা করেছেন তিনি- অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে laws of heredity অর্থাৎ বংশগতির নিয়মকানুন- জীবজন্তু ও মানুষের বেলায় similiar বা সাদৃশ্য এবং এটা আধুনিক বংশগতিরও কথা।
এবার পরিবেশ সংক্রান্ত একটি হাদিসের আলোচনা করা যাক। আজকের বিশ্বে পরিবেশ একটি বহুল আলোচিত বিষয়- বেশ কিছুদিন আগে ব্রাজিলে Rio de Janeirio তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধরিত্রী সম্মেলন বা বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। এর পর পরই সারা বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন NGO (Non Government Orgainazation), বিভিন্ন ক্লাব পরিবেশের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন- চারদিকে গাছ লাগাবার একটি হিড়িক লক্ষ্য করা যায়- এ হিড়িক একটি শুভ পদক্ষেপ, অবশ্য গাছ লাগাবার ব্যাপারটা এলোপাথাড়ি না হয়ে সুপরিকল্পিত হয়- এবং ব্যাপারটিকে monitor করা হয়- কোনখানে গাছ বাঁচল না, কোনখানে আবার লাগাতে হবে – সে সব দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, গাছের অস্তিত্বের সাথে আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্বে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ি, বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি- গাছ কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ছাড়ে। আমরা যদি বেশি মাত্রায় গাছ কেটে ফেলি এবং তা জ্বালাই, তা হলে একদিকে যেমন আমাদের এবং যান বাহন, কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করার মতো পর্যাপ্ত গাছ রইল না, অন্যদিকে কাঠ পোড়ার ফলে বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড সংযোজন করলাম। অর্থাৎ বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড build-up বা পুঞ্জীভূত হতে থাকল। এ কথা সুবিদিত যে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, water vapor, Nitrous oxide, methane ইত্যাদি গ্যাসের মাত্রা বেড়ে গেলে ভূপৃষ্ঠে যে সৌরতাপ এসে পড়ে তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই আটকা পড়ে যায় অধিক মাত্রায়- এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় green house effect- এ তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনাকে বলা হয় global warming। তাপমাত্রা বাড়লে বরফ গলবে বেশি- সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে- সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো তলিয়ে যাবে- এ এক ভয়াবহ পরিণতি। এসব কথা ভেবেই সবদিকেই গাছ লাগানোর দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে- বেশি গাছ থাকলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড এর মাত্রা কমবে- তাছাড়া গাছ মাটিকে আঁকড়ে রাখে- নদীর তীরে গাছ থাকলে global warming বা ভূমিধস হয় না- গাছের সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ ও বন্যার প্রকোপ ইত্যাদি গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
ভাবতে অবাক লাগে যে বাংলাদেশে যেখানে শতকরা ৮৬ ভাগেরও বেশি জনসাধারণ মুসলমান, সেখানে গাছ লাগানোর প্রেরণাতো অনেক আগেই আসা উচিত ছিল হাদিস থেকে। গাছ লাগানোর প্রতি নবীজি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কাঞ্জ-উল আমলে হজরত বিবি আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী নবীজি বলেছেন ‘যদি নিশ্চিতভাবে জান যে রোজ কিয়ামত এসে গেছে, তথাপি তোমার হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা লাগান যায়- তবে সেই চারা লাগাবে।’
আমরা সবাই জানি যে রোজ কিয়ামত কখন হবে সে জ্ঞান আল্লাহ দেননি। রোজ কিয়ামত যখন হবে, তখন গর্ভবতী উষ্ট্রীর গর্ভ ও প্রত্যাখ্যাত হবে- তখন কে কার কথা ভাববে- দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে- এ অবস্থাতে চারা লাগাতে যাবে কে? অথচ এ অবস্থাতে ও চারা লাগাতে বলা হয়েছে। এ হাদিসটির মারফত নবীজি বৃক্ষরোপণের প্রতি যে অসাধারণ গুরুত্ব আরোপ করেছেন- তার তুলনা হয় না। হাদিস অনুসরণ করতে হবে- এ কথা মনে করেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যদি গাছ লাগাতে শুরু করে- এবং শুরু করা উচিতও, তবে তা হবে দেশের জন্য একটি শুভ পদক্ষেপ।
জ্ঞান বিজ্ঞান সংক্রান্ত আরও অনেক হাদিস রয়েছে। সবগুলো আলোচনা করা বেশ সময় সাপেক্ষ। এ প্রসঙ্গে আমি একটি কথা-ই বলতে চাই আর তা হলো – আপনারাও অনেক হাদিস মেনে চলেন – নবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়ে এবং আল্লাহর আদেশ পালন করেই এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত হাদিসগুলো বুঝুন- ছেলেপুলেদের বুঝান এবং পালন করুন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস হচ্ছে – জ্ঞানার্জন নর ও নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য- এ হাদিস মানলে তো বাংলার ঘরে ঘরে নিরক্ষর লোক থাকবারও কথা নয়। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার আকুল আবেদন আপনারা ঘরের দোরগোড়ায় যেমন দোয়া ইউনুস লিখে রাখেন – তেমনি এখন থেকে ওই দোরগোড়ায় এ হাদিসটি লিখে রাখবেন – জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নর ও নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। আমাদের জ্ঞান বাড়লে আমরা রসুলকে ভালো করে বুঝতে পারব – আল্লাহর মহিমা বুঝতে পারব।
মহান আল্লাহ-তায়ালা আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করুন, আমরা সমুন্নত হই, একবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে মহান রবের কাছে এই হোক আমাদের প্রার্থনা।
লেখক: পরমাণু বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদ