শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়ের বাণী আউড়াচ্ছিলেন, সেই তখনই, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাটি আর মানুষের শক্তিতে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার পর চার বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু সেই সেই সময়ের মধ্যেই নবগঠিত দেশকে মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতে বড় কাজগুলোর সূচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশকে কীভাবে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন জাতির পিতা? কী ছিল তার অর্থনৈতিক দর্শন?
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ভাষায়, সত্তরের দশকের সেই বিশ্ব বাস্তবতায় এই বাংলার একজন সমাজতন্ত্রী না হয়ে ‘একজন প্রয়োগবাদী সাহসী অভিভাবক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
“তাই সংবিধানের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সম্পদের মালিকানার ধরন হবে রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত এবং সমবায়ভিত্তিক। কাজেই তিনি বাংলাদেশি ধারায়, বাঙালি গণমানুষের উপযোগী সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন এবং সেই বিশ্বাসে অটল ছিলেন।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে বুধবার এক ভার্চুয়াল সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করছিলেন ফরাসউদ্দিন। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন: শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়নে বাংলাদেশ’।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছিলেন আলোচকদের মধ্যে।
মূল প্রবন্ধে ফরাসউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করার দৃঢ় সংকল্পের কথা বলেছিলেন কবি অন্নদাশঙ্কর রায়কে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরুর পর নানা বিষয়ে মতদ্বৈততা ও বিতর্ক এমনিতেই ছিল। তার মধ্যে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মাওলানা ভাসানী সমাজতান্ত্রিক ধারা নিয়ে দল থেকে আলাদা হয়ে যান। কিন্তু মূল ধারায় সোহরাওয়ার্দীকে সামনে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারাটি শক্তিশালী করেন।
ফরাসউদ্দিন বলেন, “১৯৬০ এর দশকে ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যখন ইনকিলাব ও দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগানে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠল, তখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত। সেই প্রেক্ষিতে ব্যাংকিং ও বীমা খাতকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়।
“পাকিস্তানের লজ্জা হতে পারে যে এখন প্রতিবছর বাংলাদেশে সাড়ে এগার হাজার কোটিপতি তৈরি হচ্ছে, এবং ৪৩ হাজার অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের কাছে ব্যাংকের অর্ধেক আমানত জমা থাকছে।”
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর ৮ জানুয়ারি সে দেশের কারগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে ৩২ নম্বরে নিজের বাসায় না গিয়ে বঙ্গবন্ধু সরাসরি চলে যান তখনকার রেসকোর্স ময়দানে। লাখো জনতার উদ্দেশে সেদিন ভাসন দেন জাতির পিতা।
সেদিনের কথা তুলে ধরে ফরাসউদ্দিন বলেন, “ওই দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবকরা কাজ না পায়।
“বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আজ থেকে যেন লুটতরাজ না হয়, চুরি ডাকাতি না হয়।… এটাই কিন্তু জাতির পিতার আজীবনের সাধনা, আত্মত্যাগের রাজনীতির উপজীব্য এবং মোটাদাগে অর্থনীতির দর্শন।”
ফরাসউদ্দিনের ভাষায়, এই দর্শনে সমাজ সংস্কারের সুষম এবং সমতা প্রবণ জাতিগোষ্ঠী গড়ার প্রত্যয় ফুটে উঠে। ‘সবার সাথে সখ্য, কারও সাথে বৈরিতা নয়.- এই ঘোষণা দিয়ে কোনো সামরিক ব্লকে না গিয়ে বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে থাকার সাহসী পথ নেন। তার সেই সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীর শুভকামনা পেতে বিরাট অবদান রাখে।
“তিনি কখনো ধনতান্ত্রিক অবাধ বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অনেকটা বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি খাত থাকবে, কিন্তু একটি কাঠামোগত পরিমণ্ডল সেখানে নিয়ামক ব্যবস্থা থাকবে। তিনি মানুষে মানুষে, নারী পুরুষে, ধনী নির্ধনে, গ্রামে শহরে বৈষম্য পরিহারের কথা বলেছেন।”
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাবেক গভর্নর বলেন, “ওই দলিলে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে বিত্তবানদের ওপর অধিক কর ধার্য করে সেই অর্থ দিয়ে বিত্তহীন এবং দরিদ্রদের কল্যাণে নানা অর্থনৈতিক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।
“সমবায়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন, ‘আসুন সমবায়ের জাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রামগুলোকে জাগিয়ে তুলি। নব সৃষ্টির উম্মাদনায় জীবনে জয়গানে তাকে মুখরিত করি’।”