মৃত্যুর আগে চিকিৎসক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন আজওয়াদ ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ নামের একটি অসুখে ভুগছিল। আজওয়াদের বাবা ফজলুল করিম, মা নুরুন নাহার করিম সময়মতো ছেলের মনের অবস্থা কেন বুঝতে পারেননি, তা নিয়ে আক্ষেপ করছেন। ছেলে স্কুলের সহপাঠী এবং শিক্ষকদের কথা বলত, তখন কেন স্কুলে অভিযোগ জানাননি, তা নিয়েও ভাবছেন। আর এক আজওয়াদ চলে গেছে, কিন্তু এমন আজওয়াদ বা সন্তান তো অনেক আছে। ওদের বাঁচানোর আকুতিও জানিয়েছেন এই মা–বাবা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের আহ্বান—আর কোনো আজওয়াদকে যেন এ ধরনের পরিস্থিতিতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে না হয়।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা খাদ্যসংক্রান্ত একটি অসুখ। এতে রোগী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা রোগটি বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশে কম দেখা যায়। এটি পশ্চিমা বিশ্বের একটি অসুখ। এ অসুখকে কালচার ফিউশন এবং দ্রুত নগরায়ণের কুফল হিসেবে ধরা যায়। এখন পশ্চিমা সংস্কৃতির অনেক কিছুই অনুকরণ করার চেষ্টা করে অনেকে।
এতে রোগী ওজন কমানোর জন্য বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়া শুরু করে। ইন্টারনেট থেকে বিতর্কিত কিটো ডায়েট বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে কোনো অভ্যাস আয়ত্তে আনার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। এতে পুষ্টিহীনতায় রক্তস্বল্পতা, হাড়ের ক্ষতিসহ শারীরিক এবং মানসিক নানান সমস্যা দেখা দেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে হরমোনাল সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। আর এ অসুখের প্রধান কারণ ‘বডি শেমিং’ বা শরীর নিয়ে পরিচিতজনদের বুলিং। শরীর নিয়ে বাজে মন্তব্য শুনতে শুনতে রোগী তার চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে ভালো কথা শুনতে চায়।
আজওয়াদের বাবা ফজলুল করিম ব্যবসায়ী। মা নুরুন নাহার করিম বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য পরিচালিত একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আজওয়াদের বোন সুমাইতা ফাইজা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আজওয়াদ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার শিক্ষার্থী ছিল। প্রথম শ্রেণি থেকেই স্কুলে পড়লেও সপ্তম–অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় শরীরের ওজন নিয়ে বেশি বুলিংয়ের শিকার হতো। একপর্যায়ে স্কুলে যেতেই ভয় পেত। স্কুলে গিয়েও শ্বাস নিতে পারছে না বা নানান জটিলতা হতো, তখন স্কুলের ফোন পেয়ে তাকে বাসায় আনা হতো।
আজ শুক্রবার ফজলুল করিম ও নুরুন নাহার করিমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। নুরুন নাহার করিম বলেন, ‘ছোটবেলায় ছেলে পড়াশোনাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশ ভালো ছিল। কোচিংয়ে যেত হাসিখুশিভাবে। কিন্তু স্কুলে যেতে চাইত না। ও মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ভাবতাম খেলার জন্য স্কুলে যেতে চাইছে না। স্কুল থেকে অসুস্থ হয়ে গেলে ওকে আনতে গেলে স্কুলের আয়া–বুয়া এমনকি অনেক শিক্ষকও হাসাহাসি করতেন। মা হিসেবে এটি আমার খুব খারাপ লাগত। ছেলেকেও মাঝেমধ্যে বকা দিতাম। কেন ছেলের সমস্যাটা বুঝতে পারলাম না…?’
এই মা বললেন, অনেক সময় স্কুল পাল্টানোর কথাও ভেবেছেন। কিন্তু তাঁরা যে এলাকায় থাকেন তার আশপাশে তেমন ভালো কোনো স্কুল নেই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে অথবা স্কুল শেষ হতে তো বেশি দিন নেই এভাবেও ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন।
ফজলুল করিম বললেন, ‘আমরা স্কুলে কখনোই এ বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ করিনি। আর অভিযোগ করলে যদি ছেলে আরও অন্যায় আচরণের শিকার হয়, মারধর করে বা পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে দেয়, এসব ভয়ও কাজ করত। ছেলেও আমরা যাতে কোনো অভিযোগ না করি, তা বারবার বলত। আর অন্যান্য সমস্যা নিয়েও স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যতবার কথা বলতে গিয়েছি সেসব অভিজ্ঞতাও ভালো ছিল না। স্কুলে গিয়ে অভিযোগ জানানোর দুঃসাহস তো অভিভাবকদের নেই। ছেলে মারা যাওয়ার পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং আরেকজন শিক্ষক বাসায় এসে ক্ষমা চেয়েছেন। আমরা আগে যদি অভিযোগ করতাম তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারতেন বলেও বলেছেন। কিন্তু এখন তো সবই শেষ। ছেলেই তো চলে গেল।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ছেলের শারীরিক ও মানসিক সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারেন এই বাবা–মা। চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেকে একই সঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডায়েটিশিয়ান, সাইকোলজিস্ট এবং সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে ওজন দ্রুত কমে ২৯ কেজিতে নেমে আসে। তখন ছেলের শরীরে হাড্ডি আর চামড়া ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না। একসময় পাঁচ কেজি ওজন বাড়েও। তবে গত ২৫ জুন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন সেচুরেশন কমা যাওয়াসহ নানান জটিলতায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর আইসিইউ, ভেন্টিলেশনে থাকার পর ২৬ জুন রাতে মারা যায়। নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষাসহ হাসপাতালের বিল আসে আড়াই লাখ টাকা।
ফজলুল করিম বললেন, ‘ওজন বেশি দেখে আমরাও মাঝেমধ্যে বলতাম একটু শুকানোর জন্য। একসময় দেখলাম সে অনেক বেশি ব্যায়াম করছে। কম খাচ্ছে। শুকানোও শুরু করেছে। ৯৩ কেজি থেকে ৬০ কেজিতে নেমে আসে। আমরা এটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ভেবেছিলাম। ওজন ৬০ কেজি হওয়ার পর আমরা ওকে কম খেতে নিষেধ করি। কিন্তু ও একটু বেশি খেলেই বমি করে দিত। ওর মনে হতো আরও শুকাতে হবে। তত দিনে যা হওয়ার তাই হয়ে গেছে। ও পুরো প্রক্রিয়াটাই আমাদের কাছে গোপন করার চেষ্টা করেছিল। আমরাও বুঝতে পারিনি। ছেলেকে বমি করতে নিষেধ করলে বলত, আমার বমি করতে ইচ্ছে করছে। বেশি খেলে আবার মোটা হয়ে যাবে, এ ভয় কাজ করত তার মনে।’
এই বাবার আকুতি, ‘আপনারা আপনার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখবেন। স্কুলে যাতে কোনোভাবেই বুলিংয়ের শিকার না হয়। শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কেউ মোটা, শুকনা, কালো হলেই তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা যায় না। তারা মজা করছে, কিন্তু যাকে নিয়ে করছে এটা তার জন্য ভয়াবহ মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। শিক্ষকেরাও তো অভিভাবক, তাঁদেরও সচেতন হতে হবে যে কোনো শিক্ষার্থীকে তাঁরা যাতে হাসির পাত্র না বানান।’
এই বাবা–মা বললেন, স্কুলে মটু, বেঞ্চে বসলে পেছন থেকে সহপাঠীদের খোঁচা দেওয়া তো ছিলই। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার ফুটবল দলে নাম লেখাতে চেয়েছিল ছেলে। তখন ছেলের এক শিক্ষক প্রথমেই বলেছিলেন, তুই তো মোটা, তুই তো হাঁটতেই পারিস না। খেলবি কেমনে? এটুকু বলেই থামেননি। আরেক শিক্ষার্থীকে ডেকে টেবিল সরিয়ে দিয়ে আজওয়াদকে সেখানে হাঁটতে বাধ্য করেন। এ সময় আজওয়াদের অন্য সহপাঠী ও শিক্ষক হেসেছিলেন।
আজওয়াদের মা নুরুন নাহার করিম বললেন, ছেলে এ ঘটনা বাসায় এসে বলে বলেছিল, সবার হাসি দেখে তার নাকি মরে যেতে ইচ্ছে করেছিল। এই মায়ের আক্ষেপ, তখনই যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে আজ আর এই অবস্থা হতো না।
নুরুন নাহার জানালেন, স্কুলে ছেলের তেমন কোনো ভালো বন্ধু ছিল না। তবে বাবা–মা, বোন, চাচাতো ভাই–বোন সবার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বললেন, ‘মারা যাওয়ার আগে ছেলেটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। হাতে–পায়ে পানি আসে। তিন মাস হাঁটতেও পারত না। শরীর থেকে পানি শুকিয়ে গেলে ছেলেটার শরীরে হাড্ডি ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বললেন,‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ দ্রুত শনাক্তকরণ জরুরি। এ অসুখে ওষুধের চেয়েও সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিং বেশি জরুরি। আর রোগীর শারীরিক সমস্যা ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। খাবার নিয়ে সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে খিদে কমে যাওয়াসহ যেকোনো জটিলতা দেখা দিলে তাকে অবহেলা না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। শারীরিক জটিলতা শুরুর আগেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতায় বললেন, ১০ বছর আগেও তাঁর চেম্বারে বুলিংয়ের শিকার হয়েছে, এমন ছেলেমেয়ে কম আসত। এখন সংখ্যাটা অনেক বেড়ে গেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও ওজনাধিক্যের কারণে স্কুল পারফরম্যান্স খারাপ হচ্ছে বলে অভিভাবকেরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘লম্বু’, ‘চিকনা’, ‘মটু’ এমনকি ‘তুই নোয়াখাইল্যা’ বলে একটা পর্যায় পর্যন্ত মজা থাকলেও তা একসময় আর মজা থাকে না। যে কিশোর মারা গেছে এই পরিণতি অন্যদেরও হতে পারে। তাই সচেতনতা জরুরি।