ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তাদের এলাকার ১০৩টি জায়গার জলাবদ্ধতার কারণও সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে। যেসব জায়গার সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধানযোগ্য, সেগুলো সমাধানে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু এলাকার জলাবদ্ধতার সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সরু নালা, প্রকল্পের নির্মাণকাজের মতো বিষয় যুক্ত। সেগুলোর সমাধানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আবার কিছু এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। সেসব এলাকার সমস্যা সমাধানে আলাদা প্রকল্প নেওয়া হতে পারে।
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর নতুন করে কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। জলাবদ্ধতার জায়গাগুলো চিহ্নিত হয়েছে। ছয়টি হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ঢাকার যেকোনো স্থানে বৃষ্টির পানি যাতে এক ঘণ্টার মধ্যে নেমে যায়, সে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের চিহ্নিত ৫৩টি জায়গার জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৩৯ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় এবারের বর্ষা মৌসুমে অন্তত ২৫টি এলাকার নর্দমা সংস্কার ও পাইপ বসানো হচ্ছে। এর বাইরেও নর্দমা ও ফুটপাতের উন্নয়নের কিছু কাজ চলমান। ডিএসসিসির প্রত্যেক কাউন্সিলরকে এক কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই টাকাও তারা নর্দমা ও ফুটপাতের সংস্কারকাজে খরচ করছেন।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ৫৩টি স্থানের চলমান কাজ আগামী ২০ দিনের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই কাজগুলো শেষ হলে চলতি বর্ষায় জলাবদ্ধতা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। ডিএসসিসি এলাকায় বৃষ্টির পানির ধারণক্ষমতা প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ। এটি বাড়াতে হবে।
গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। এরপর খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের কাজ করছে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। তবে নগরবিদ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু খাল পরিষ্কার রাখলেই জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। বৃষ্টির পানি নর্দমা হয়ে খালের মাধ্যমে নদীতে যাওয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ছাড়া জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। তাদের আশঙ্কা, চলতি বর্ষার পাশাপাশি আগামী বর্ষাতেও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি রাজধানীবাসীর সঙ্গী হবে।
নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব আগেও সিটি করপোরেশনের ছিল। এখন খালের অংশটুকু যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হয়েছে। শুধু প্রকল্পভিত্তিক সমাধানের চিন্তা করলে হবে না। জলাবদ্ধতার পুরো নেটওয়ার্ক ও অনুষঙ্গ চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে সমাধান করতে হবে।
বাকি খালও দুই সিটির দায়িত্বে
ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২৬টি খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর বাইরেও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ১৭টি খাল রয়েছে। এ খাল ও জলাশয়গুলোও সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হস্তান্তরপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী হস্তান্তরপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্প
গত ৩১ ডিসেম্বর খালগুলোর দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। খালের সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দিয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, কালুনগর, জিরানী, মান্ডা ও শ্যামপুর খাল উন্নয়নের জন্য ৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছে ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’। প্রকল্পের আওতায় খাল উদ্ধার করে দুই পাড়ে বানানো হবে হাঁটাপথ, সাইকেল লেন, মাছ ধরার ছাউনি, বাগান, পদচারী–সেতু, গণশৌচাগার।
ঢাকা উত্তর সিটিও জলাবদ্ধতা নিরসন ও খাল নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে। খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা, খালগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে জমা মাটি অপসারণ করে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি এবং খালের দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা, সাইকেল লেন ও গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প তৈরি করে তা বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছে, অনেক দেরিতে হলেও বিষয়টি ইতিবাচক। এসব জায়গার জলাবদ্ধতার ত্বরিত সমাধানে বড় প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি বর্জ্য নিয়ে যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেটি বন্ধে জোর দিতে হবে। জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে বাসাবাড়িসহ অন্যান্য বর্জ্য খালে না ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সুত্র : প্রথম আলো