শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি কে, এমন প্রশ্ন করলে মুহূর্তেই শোনা যাবে জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গ, বিল গেটস কিংবা ওয়ারেন বাফেটের নাম। কিন্তু এসব কোনো উত্তরই সঠিক নয়। সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তাদের কেউই নন! তিনি ছিলেন আফ্রিকার এক মুসলিম রাজা! যার নামটি অনেকে শোনেনইনি কখনো। তার নাম মানসা মুসা।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থ’ জানায়, মুসার সম্পদের পরিমাণ ছিল আজকের যুগের প্রায় ৩৫ লক্ষ কোটি টাকার সমান! ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানি ডট কম’ এ জ্যাকব ডেভিডসন লিখেছিলেন, যতোটা বলা সম্ভব তার চেয়েও বেশী ধনী ছিলেন মানসা মুসা।
তবে এমন অসীম ধনসম্পদ ছাপিয়ে ৬০,০০০ লোক এবং হাজার হাজার চাকরবাকরের সুবিশাল বহর নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে মুসার ৪,০০০ মাইল হজযাত্রার কাহিনী ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। টিআরটি ওয়ার্ল্ড এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ
মানসা মুসার জন্ম ১২৮০ সালে আফ্রিকার মালিতে। তার এলাকার স্থানীয় ভাষায় মানসা নামের অর্থ হলো ‘সুলতান’। তিনি ১৩১২ সালে সিংহাসনে বসেন এবং তার ২৪ বছরের শাসনামলে তৎকালীন মালি সাম্রাজ্য এখনকার সেনেগাল, মালি, বুর্কিনা ফাসো, নাইজার, গিনি এবং আইভরি কোস্ট পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছিল।
ইবনে খালদুন, ইবনে ফজলুল্লাহ আল ওমারি, আবদুল্লাহ এস সাদির মতো বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক মুসার কথা উল্লেখ করে গেছেন। ১৩৫২ সালে মালি সফরকালে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাও তার সম্পর্কে লিখেছিলেন।
তারা সবাই মানসা মুসা এবং তার বিখ্যাত হজযাত্রাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৩২৪-১৩২৫ এর দিকে মুসা হজযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এমন যাত্রা কেউ কখনো দেখেনি আগে। মুসা আক্ষরিক অর্থেই সোনা ছিটিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন এবং নিজ সাম্রাজ্যকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেন।
মুসা তার পুত্র মোহাম্মদকে রাজধানী নিয়ানিতে সাময়িকভাবে নিজের দায়িত্বে বসিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ৬০,০০০ লোকের পাশাপাশি তার নিজের এবং স্ত্রী ইনারি কুন্তির হাজার হাজার ব্যক্তিগত চাকরবাকর তার সহযাত্রী হন। মুসার ব্যাগভর্তি ছিল হাজার হাজার কেজি সোনা। কেউ বলে দুই টন, কেউ বলে ২০ টন। এগুলো সব উট, খচ্চর এবং হাতির পিঠে ছিল। যতদূর চোখ যায় তার কাফেলাই চোখে পড়ছিল। অনেকের দাবি, কাফেলাটি পার হতে পুরো একদিন সময় লেগে যেতো।
মুসা ধার্মিক ছিলেন। তিনি তার উদারতার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। তিনি যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে প্রতি শুক্রবার একটি করে মসজিদ তৈরি করেছিলেন এবং সব জায়গায় এতো সোনা দিয়েছিলেন যে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি বারো বছরের জন্য অস্থিতিশীল হয়ে যায়।
ভ্রমণকালে কায়রোতে বিখ্যাত মামলুক সুলতান আল মালিক আল নাসিরের সাথে মুসার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল মালিকের সাথে দেখা হলে তাকে প্রোটোকলের অংশ হিসেবে হাঁটু গেড়ে বসতে বলা হয়, কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার জানিয়ে বলেন, তিনি কেবল আল্লাহ’র সামনেই মাথা নত করবেন আর হাঁটু গেড়ে বসবেন। মুসা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি কেবল হজ করতেই বেরিয়েছেন, রাজনীতি নিয়ে কোন কথা বলতে চান না। তারপর তিনি মামলুকের কোষাগারে প্রচুর পরিমাণ সোনা দান করেন। মামলুকের সুলতান জবাবে মুসাকে তার প্রাসাদে থাকতে দিয়েছিলেন।
যে কয়দিন মুসা সেখানে ছিলেন তার লোকজন (এক দিনারের জায়গায় পাঁচ দিনার বা তার বেশি দাম দিয়ে) বিপুল পরিমাণ কেনাকাটা করে স্থানীয় বাজারকে চাঙ্গা করে তোলে। তাদের এমন ব্যয়ের জন্য মুদ্রার মান এতোটাই হ্রাস পেয়েছিল যে ১২ বছর পরও বাজার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা যায়নি।
মুসার সফরের ১২ বছর পর কায়রো সফর করেন ঐতিহাসিক আল ওমারি। তখন ওই শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লক্ষ। শহরের বাসিন্দারা তখনও মুসার প্রশংসায় মত্ত ছিল। ওমারির বর্ণনায়- মুসার দানে কায়রো প্লাবিত হয়েছিল।
মুসা মক্কা-মদীনায় বিপুল পরিমাণ সোনা দান করেছিলেন। তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের জমি ও বাড়ি দিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনকে তার সাথে মালিতে আসতে রাজি করান। কেউ কেউ বলেন, তিনি মালি সাম্রাজ্যের বিকাশের জন্য শিল্পী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদেরও সাথে করে নিয়ে এনেছিলেন।
তিনি হেজাজে (এখনকার সৌদি আরব) তিন মাস অবস্থান করেছিলেন এবং ফিরে আসার সময় তার কাফেলাটি বেদুইনদের আক্রমণের শিকার হয়। কায়রো পৌঁছে তিনি মামলুকের সুলতানের সাথে পুনরায় দেখা করেন এবং মিশরীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে চান।
(মালির) তিম্বুক্ত ফিরে এসে মুসা বিখ্যাত জিংগুয়েরেবার মসজিদ নির্মাণ করেন এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম শিক্ষার্থী ও পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা মালিকে আফ্রিকার জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। মুসা তার দেশে বৈজ্ঞানিক আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের মরক্কো প্রেরণ করেন।
তিনি পুত্র মেগার কাছে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই (১৩৩৭ সালে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর পর মালি সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এরপর ওই অঞ্চলে ইউরোপীয়দের আগমন ছিল সাম্রাজ্যটির কফিনে বিদ্ধ শেষ পেরেক।
মুসার মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৩৩৯ সালে বিখ্যাত
কার্টোগ্রাফার (মানচিত্রকর) অ্যাঞ্জেলিন ডুলসার্ট তার প্রতিকৃতি আঁকেন যা মালির একটি মানচিত্রে দেখা যায়। মুসা মালিকে বিখ্যাত করে তোলার কারণে ইউরোপীয় কার্টোগ্রাফাররা ক্রমশ মালিকে তাদের মানচিত্রে স্থান দিতে শুরু করে।
বিখ্যাত মধ্যযুগীয় বিশ্ব মানচিত্র ‘কাতালান অ্যাটলাস’ এ মুসা স্থান পেয়েছিলেন। যেখানে নিজ দেশের সম্পদের প্রতীক হিসেবে এক হাতে রাজদণ্ড এবং অন্য হাতে সোনা নিয়ে তাকে সাহারার কেন্দ্রে দেখা যায়।
অ্যাটলাসে তাকে সবচেয়ে ধনী কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি এবং মালির সুলতান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যিনি সুদান অঞ্চলের সবচেয়ে মূল্যবান সোনার উৎসের মালিক। কাতালান অ্যাটলাসে ওই অঞ্চলের বাণিজ্যের রুটগুলোকেও (তাঘাজা, তিম্বুক্ত, মালি এবং গাঁও) চিহ্নিত করা হয় যার ফলে তা ইউরোপের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ওই অঞ্চলটি ঘুরে দেখার এবং মহাদেশটিতে উপনিবেশ স্থাপনে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে একীভূত করে। মুসার হজযাত্রা, উদারতা এবং খ্যাতি বিশ্বকে আফ্রিকার বিশেষত মালির বিপুল ধন সম্পদের প্রতি মনোযোগী করে তোলে।