শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫
মুসলিম বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে ক’বছর আগেও পাল্টাপাল্টি হিসাবে উভয় দেশ নিজ নিজ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে বসিয়ে রেখেছিল। কূটনীতিতে ‘তিক্ততার মাত্রা’ চরমে উঠলেই কেবল এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়, যা বাংলাদেশ এবং তুরস্ক উভয়েই করেছে। কিন্তু আজ সময়ের পরিক্রমায় দুই দেশের সম্পর্ক শুধু স্বাভাবিকই হয়নি বরং এটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। অতি সম্প্রতি তুরস্ক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। আঙ্কারায় গত সপ্তাহে চুক্তিটি সই হয়েছে। তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের মূল্যায়ন হচ্ছে- তুরস্কের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কে বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। ওআইসিতে নেতৃস্থানীয় অবস্থান এবং ন্যাটোর অংশীদার তুরস্কের সক্ষমতা বাড়ছে।
বিশ্ব জনমত তৈরিতেও দেশটি অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠিত জার্নাল বাংলাদেশ ডিফেন্স এনালিস্ট ডিফসেকএ’র মতে, সদ্য সই হওয়া গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃরাষ্ট্রীয় ওই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ও তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ বৃদ্ধি পাবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-সিপরি’র তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ইতিমধ্যে তুরস্ক থেকে কোবরা এপিভি গাড়ি ও শর্ট-রেঞ্জ মিসাইল কিনেছে। চুক্তি সই বিষয়ে রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে প্রচুর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ঢাকা সফর করতে পারেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা আশা করি, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরেই তিনি ঢাকা সফর করবেন। অবশ্য সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলছেন, যেকোনো রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সফর অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপে সফর ‘টুল’ বা উপাদান হিসেবে বিবেচ্য। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী কিন্তু কবে আসতে পারবেন তা নির্ভর করছে করোনার অভিশাপ থেকে দুনিয়া কবে মুক্তি পায় তার ওপর। কর্মকর্তারা বলেন, এরদোগানের সফরের জন্য অপেক্ষায় না থেকে উভয় দেশই সম্পর্ককে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’র পর্যায়ে নিয়ে যেতে কাজ করছে। তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সইয়ের পর আঙ্কারার ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল ডেমি এক টুইট বার্তায় ‘থেমো না, এগিয়ে যাও’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেন- রকেটসান থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তুরস্কের সরকারি কোম্পানি রকেটসান স্থল, সমুদ্র ও আকাশে ব্যবহারযোগ্য ন্যাটোর মানদণ্ড অনুযায়ী অস্ত্র তৈরি করে থাকে। উল্লেখ্য, করোনাকালেও তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত সফর বিনিময় হচ্ছে। করোনার প্রথম আঘাত সামলে দুনিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তুরস্ক সফর করেন। সে সময় দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তার আলোচনা ছাড়াও নবপ্রতিষ্ঠিত চ্যান্সারির উদ্বোধন করেন তিনি। সেই সফরের ফিরতি সফর হিসেবে ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভোসুগলো। তিনিও রাজধানীতে তুরস্কের নতুন চ্যান্সারি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। আলোচনা করেন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে। সে সময় তার আলোচনায় বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের কাছে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব। তখন তার ভাষ্যটি ছিল এমন ‘আমাদের প্রতিরক্ষা পণ্যের গুণগত মান অত্যন্ত ভালো, দাম সুলভ। এগুলো কেনার জন্য আমরা কোনো দেশকে কোনোরূপ শর্ত আরোপ করি না। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ আমাদের এসব সুবিধা গ্রহণ করবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত প্রতিরক্ষা খাতে তুর্কি প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ উৎপাদনেরও প্রস্তাব করেছিলেন।
বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের উষ্ণতা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-তুরস্ক সামপ্রতিক উষ্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব কি বা কতোটা? তা নিয়ে বিবিসি একাধিক বিশ্লেষণ ছেপেছে। একটি রিপোর্টে বলা হয়- মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের এক শীর্ষ নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের পর প্রেসিডেন্ট এরদোগান এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, ঢাকা থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ওই বিচার ঠেকাতে ২০১২ সাল থেকে চেষ্টায় ছিল তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের কাছে চিঠি পাঠান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল। সেই চিঠিতে নেতাদের ফাঁসি হলে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও হুঁশিয়ারি ছিল। চিঠি পাঠানো ছাড়াও বিচার পর্যবেক্ষণে দেশটির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছিল। পরিচয় গোপন করার অভিযোগে তাদের আটক এবং পরবর্তীতে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ। বিসিসি তার রিপোর্টে দেখিয়েছে- যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ থেকে ’১৬ সাল পর্যন্ত তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতোটা অচলাবস্থায় ছিল। তবে তারা এ-ও বলেছে, দুই দেশের সম্পর্কে বেশ নাটকীয় উন্নতি ঘটে ২০১৬ সালের জুলাইতে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর। সে সময় ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে বার্তা পাঠান। তখন রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল সময় পার করছিলেন তুরস্ক। এরদোগানের প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন, আর তাই তিনি চটজলদি তার রাষ্ট্রদূতকে ঢাকায় ফেরত পাঠান। তুরস্কের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ-এর উপদেষ্টা সেলচুক কোলাগ্লু এ নিয়ে এক নিবন্ধে লিখেন, ’১৭ সালের ডিসেম্বরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ তুরস্ক সফর করেন। এর কিছুদিন পরেই তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই বছরে রোহিঙ্গা সংকট প্রকট আকার ধারণ করলে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তুরস্ক এগিয়ে আসে। বাস্তুচ্যুতদের দেখতে এবং ঢাকার পাশে থাকার বার্তা স্পষ্ট করতে খোদ ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান বাংলাদেশ সফর করেন। তাছাড়া ওই জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বেশ সক্রিয় হতে শুরু করে তুরস্ক। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশ কয়েক বছরের শীতলতা কাটিয়ে বাংলাদেশ-তুরস্কের সম্পর্ক এমন এক সময় উষ্ণ হয়েছে, যখন মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। মুসলিম দেশগুলো বরাবরই সৌদি আরবের প্রতি অনুগত। কিন্তু এরদোগান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তুরস্ক সেখানে ভাগ বসাতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে ইরান, তুরস্ক, কাতার এবং সিরিয়াকে নিয়ে নতুন এক মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। ইরান এবং তুরস্কের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বেশ ভালো। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় দু’টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু সমপ্রতি পাকিস্তান ভূ-রাজনীতির নতুন এক পটভূমিতে ইরান এবং তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। ওই মেরুকরণে বাংলাদেশ ও তুরস্কের সামপ্রতিক এই উষ্ণতা কী বার্তা দিচ্ছে? সেই প্রশ্নে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি-তুরস্ক ঠাণ্ডা লড়াই বাংলাদেশকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশ সৌদি আরবকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং ভবিষ্যতেও সেটা করবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়াও মক্কা ও মদীনার কারণে বাংলাদেশের কাছে সৌদি আরবের বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের মতে, তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে। এতে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন না তিনি। তার মতে, ইরান, তুরস্ক এবং সৌদি আরব কারও সঙ্গেই বাংলাদেশের কোনো বৈরিতা নেই বরং সবার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ভালো।
কী ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম উৎপাদন করে তুরস্ক?
বাংলাদেশে তুরস্কের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর এ নিয়ে একটি রিপোর্টে বিবিসি বাংলা বলেছে, মাত্র দু’দশক আগেও তুরস্ক বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ছিল। এখন (২০১৮ সালে) তারা বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। টার্কিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসেম্বলির বরাতে রিপোর্টে বলা হয়, করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে ক্রমশই বাড়ছিল। ২০১৮ সালে দেশটির সব রপ্তানি খাতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সামগ্রীর রপ্তানির প্রবৃদ্ধিই ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই বছরে প্রথমবারের মতো দেশটি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানিতে সক্ষম হয়। এরপর তুরস্ক ২০১৯-২৩ সাল সময়ের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাতে ’২৩ সাল নাগাদ প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি ১,০০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার টার্গেট ধরা হয়েছে। সুইডেনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সিপরি’র তথ্য মতে, সামরিক খাতে তুরস্ক ২০১৯ সালে ব্যয় করেছে ২,০০০ কোটি ডলারের বেশি। দেশটির প্রতিরক্ষা খাত নিয়ন্ত্রণ করে টার্কিশ আর্মড ফোর্সেস ফাউন্ডেশন, যার মূল কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্ট এরদোগানের হাতে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্ট্যাডিজের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পখাত। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর দরকার- এমন সব কিছুই তারা এখন তৈরি করে। বাংলাদেশ আগেও সমরাস্ত্র আমদানি করেছে তাদের কাছ থেকে। এখন তাদের প্রযুক্তি অনেক আধুনিক। ওই বিশ্লেষক মনে করেন স্থল ও নৌ বাহিনীর প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্টের অনেক কিছুই তুরস্ক তৈরি করছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষুদ্রাংশ সরবরাহ এবং ব্যাকআপ সার্ভিসও দিচ্ছে বিভিন্ন দেশকে। সুইডেনভিত্তিক সিপরির তথ্য মতে, বহু বছর ধরে চীন, ইতালি, রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, সার্বিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি থেকে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামাদি আমদানি করে। বর্তমানে তুরস্ক থেকে কিছু সরঞ্জাম আমদানি করছে। তবে তুরস্ক চাইছে বাংলাদেশ আরও বেশি পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করুক।