মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

কাচ্চি বিরিয়ানির ইতিকথা 

কাচ্চি বিরিয়ানি

অনুষ্ঠানে হোক কিংবা বন্ধুদের বিশেষ আড্ডা – বাঙালির কাছে কাচ্চি বিরিয়ানির কদর যেন অতুলনীয় । বিশেষ করে তা যদি হয় পুরান ঢাকার আদি ও আসল স্বাদের, তাহলে তো কথাই নেই ।  কিন্তু  কি কখন থেকে বা কার ,মাধ্যমে চালু হলো এই সুস্বাদু খাবার ? চলুন জেনে আসা যাক ঐতিহ্যবাহী কাচ্চির ঐতিহ্যমন্ডিত ইতিহাস ।

বিরিয়ানির রকমভেদ 

বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ এবং ‘বিরিঞ্জি’ থেকে। ‘বিরিয়ান’ অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া এবং ‘বিরিঞ্জি’ মানে চাল। নামের প্রতিটি অংশের পেছনেই মূলত কারণ এর রন্ধন কৌশলের কোনো না কোনো অংশ। যেমন- বিরিয়ানি রান্না করার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নিতে হয়, তাই এই নামকরণ। বিরিয়ানি মূলত দুই প্রকার- কাচ্চি এবং পাক্কি।




কাচ্চি  বনাম পাক্কি  

‘কাচ্চি’ শব্দটির উৎপত্তি উর্দু  শব্দ ‘কাচ্চা’ থেকে। যার বাংলায় প্রতিশব্দ হলো ‘কাঁচা’ । কাচ্চি বিরিয়ানিতে সেদ্ধ ছাড়াই কাঁচা মাংস সুগন্ধি চালের সাথে মিশিয়ে রান্না করা হয়। হিন্দি এবং উর্দুতেও এই মুঘল খাবারটি ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’ নামেই পরিচিত। কাচ্চি বিরিয়ানিতে বিভিন্ন মালমশলা দিয়ে মাখানো খাসির মাংসের উপর সুগন্ধি চাল ও আলুর আস্তরণ দেওয়া হয় এবং রান্নার হাড়ির চারদিকে আটা বা ময়দার তাল বা ডোর (Dough) মাধ্যমে ঢাকনা বায়ুরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। রান্না করার এই পদ্ধতির নাম ‘দম পোক্ত’। আর যেহেতু কাঁচা মাংস সরাসরি দমে দিয়ে রান্না করা হয় তাই এর নাম ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’। অন্যদিকে, ‘পাক্কি বিরিয়ানি’-এর ‘পাক্কি’ শব্দের অর্থ রান্না বা পাক করা। এক্ষেত্রে বিরিয়ানির মাংস মশলা দিয়ে কষিয়ে আগে থেকেই ভেজে সেদ্ধ করে নেওয়া চালের সাথে মিশিয়ে দমে রান্না করা হয়। তাই একে বলে পাক্কি বিরিয়ানি ।

কাচ্চি বিরিয়ানির ইতিকথা 

মধ্য এশিয়ার  তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানের চাঘতাই জাতির মানুষদের মধ্যেই প্রথম এই খাবারের প্রচলন শুরু। শীতপ্রধান এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের লাল মাংস , বিশেষ করে ভেড়ার মাংস বেশ পছন্দের। ভেড়ার মাংসের সাথে চাল ও বিভিন্ন উপাদান, যেমন- মাখন, গোলমরিচ, লবণ, এলাচ এবং স্থানীয় মশলা জয়ফল ব্যবহার করে তারা একটি বিশেষ খাবার প্রস্তুত করতে শেখে। আর এভাবেই যাত্রা শুরু কাচ্চি বিরিয়ানির। বলা হয়, ১৩৯৮ সালে ভারতবর্ষে  তৈমুর লংয়ের আগমনের সাথে সাথে এই বিরিয়ানিরও আগমন ঘটে। তৈমুরের সেনাবাহিনীর জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার জন্য চাল, বিভিন্ন মসলা এবং যে মাংস যখন সহজলভ্য তা একটি হাড়িতে নিয়ে গনগনে গরম একটা গর্তে হাঁড়িটি চাপা দিয়ে দমে রান্না করা হতো এই কাচ্চি।

ভারতবর্ষে বিরিয়ানির আগমনের পেছনে  মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের অবদান অনেক বেশি শোনা যায় । বলা হয় একবার সম্রাজ্ঞী ব্যারাকে গিয়ে সৈন্যদের দুর্বল ও রুগ্ন অবস্থা দেখতে পান। তাদের  সাস্থ্যের অবস্থা  মমতাজকে চিন্তিত করে তোলে। তিনি বাবুর্চিকে ডেকে চাল ও মাংস দিয়ে এমন একটি বিশেষ খাবার প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে। নির্দেশ অনুসারে একটি বিশাল হাঁড়িতে চাল, মাংস এবং হরেক রকমের মসলা দিয়ে অল্প আঁচে ও দমে কয়েক ঘণ্টা রান্না করে তৈরি হয় একটি বিশেষ খাবার, তথা বিরিয়ানি। রান্নার পদ্ধতি দুটি বিরিয়ানিরই  বা পাক্কি বিরিয়ানির চেয়ে কাচ্চি বিরিয়ানির আগমনের গল্পই বলা যায়। পরবর্তীতে মুঘল সুবেদারদের সাথে আসা রাঁধুনিদের মাধ্যমে ঢাকা শহরে খুব অল্প সময়ে এই বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকাইয়া কাচ্চি বিরিয়ানি

বর্তমানে ঢাকার অন্যতম বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে ‘ঢাকাইয়া কাচ্চি’। ১৯৩৯ সালের দিকে ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির যাত্রা শুরু। খুব অল্প সম্যের মধ্যেই এটি অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে । বর্তমানে পুরান ঢাকায় গেলেই দেখা মিলে সারি সারি কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানের । স্বাদে, মানে একটি অন্যটিকে ছাপিয়ে যায় । প্রতিটি দোকানের বিরিয়ানিরই কোনো না কোনো বিশেষত্ব রয়েছে। কোথাও হয়তো  বিরিয়ানিতে ঘি বা মাখনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় শুধুই সরিষার তেল, আবার কোথাও খাসির মাংসের বদলে গরুর মাংস। সর্বক্ষণই জমজমাট পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানগুলো। আসল কাচ্চির স্বাদ নিতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে এখানে। প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলায় রাজত্ব করা মুঘল খাদ্য ভাণ্ডারের এই সুস্বাদু খাবারটির অতুলনীয় স্বাদ উপভোগ করতে, পরিবার সমেত আপনিও ঘুরে আসতে পারেন পুরান ঢাকায়।

 

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১