বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
ঋত্বিক ঘটক বিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। উল্কার মতোই জ্বলে উঠে ধুপ করে নিভে যাওয়া এক খ্যাপা শিল্পস্রষ্টা। চলচ্চিত্রপাগল এক মানুষ ছিলেন ঋত্বিক। সিনেমা নির্মাণ করতেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য; নিজের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য। কখনো খ্যাতি কিংবা পুরস্কারের কাছে মাথানত করেননি। মাত্র আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি করেই এখনো চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম ঋত্বিক ঘটক।
বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ায় ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর নন্দিত এ চলচ্চিত্র নির্মাতা জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় কিছুদিন দাদা মনীশ ঘটকের সঙ্গে কলকাতায় ছিলেন। তখন পড়াশোনা করতেন দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজশাহী শহরে ফিরে যান। রাজশাহী শহরের পৈতৃক বাড়িতে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের একটি অংশ কাটিয়েছেন। এ বাড়িতে কিছু সময় বসবাস করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীও। ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তিনি সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনীয়। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি যেমন প্রশংসিত ছিলেন; ঠিক তেমনি বিতর্কিত ভূমিকাও রাখেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নাম বহুল উচ্চারিত। ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। তার বড় ভাই ওই সময়ের খ্যাতিমান এবং ব্যতিক্রমী লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক ও সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক জড়িত ছিলেন। তার মেয়ে বিখ্যাত লেখিকা ও সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবী। ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। ঋত্বিক ঘটক তার প্রথম নাটক কালো সায়র লেখেন ১৯৪৮ সালে। একই বছর তিনি নবান্ন নামক পুনর্জাগরণমূলক নাটকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। এ সময় নাটক লেখেন, পরিচালনা ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশট ও নিকোলাই গোগোলের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। তার বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার এবং সুবর্ণরেখা অন্যতম। এ তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে জুলাই মাসে ছোট একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন; যার নাম দুর্বার গতি পদ্মা। সেখানে তিনি এক মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে বলা টুকরো টুকরো নানা তথ্য, ঘটনা, প্রতীকের সমন্বয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের করা গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও পরবর্তীকালে ভাইস প্রিন্সিপাল হন। তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। ভারত সরকার তাকে শিল্পকলায় পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই গুণিজনের জীবনাবসান ঘটে।