সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
হুমায়ুন কবীর, রাজশাহীঃ
আলামত হিসেবে জব্দকৃত মোবাইল ফোন থেকে প্রচারিত বার্তা নিয়ে বিপাকে চন্দ্রীমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমরান।
ঘটনাটি রাজশাহীর ভদ্রা জামালপুরের হতদরিদ্র চা বিক্রেতা মাজদারের বড় কন্যা মুর্শিদার আত্মহত্যা নিয়ে । তরুনী মুর্শিদার বিয়ে হয় প্রতিবেশী এক প্রতিবন্ধি যুবকের সাথে, অপমৃত্যুর ৩মাস আগে পারিবারিক কারণে তালাকও হয় তাদের। তালাকের পর তরুনী মুর্শিদার স্মার্ট ফোনেই আসতো তার সাবেক স্বামীর প্রতিবন্ধী ভাতা। ৭ বছরের একটা সন্তানও আছে এই দম্পতির। তবে তালাকের পর থেকে মা-বাবা ও ছেলেকে সাথে নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো তরুনী মুর্শিদা (২৫)। হঠাৎ, গত (৮ নভেম্বর) মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যানের হুকের সঙ্গে গলায় ওড়না দিয়ে আত্মহত্যা করে তরুনী মুর্শিদা (২৫) ঘটনাটি পল্লী বার্তা লাইভে প্রচার করা হয়। সুরতহাল রির্পোটেও আত্মহত্যা ব্যাতিত কিছু পাওয়া গিয়েছিল না। তবে, ঘটনার শুরু মৃত মুর্শিদার মোবাইলকে ঘিরে। যতই দিন যায় ততই যেনো মোবাইলটি নিয়ে বাড়তে থাকে রহস্য।
মৃত তরুনীর মোবাইল ফোনটি কোথায় আছে জানে না পুলিশ। পরিবার ও নিকটতম এক আত্নীয়ের দাবি ঘটনার দিনই একজন পুলিশ সদস্য আলামত হিসেবে গলায় পেঁচানো ওড়না ও ব্যাবহৃত মোবাইল ফোনটি জব্দ করে। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি ফোনটি পুলিশের কারো কাছেই নেই।
এদিকে, ঘটনার কয়েকদিন পরই সেই ফোন থেকেই রাজশাহী চন্দ্রিমা থানা পুলিশের অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) ইমরানের নামে একাধিক অভিযোগ এবং ৩২ লক্ষ টাকা আদান প্রদানের একটি খুদে বার্তা বা এসএমএস প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর সহ খোদ ওসির ফোনে পাঠানো হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় ফোনটি কার কাছে রয়েছে এটি এখন পর্যন্ত অজানা রহস্যে ঘেরা। তবে, পুলিশ এবং ভুক্তভোগী পরিবারের দাবী অতি দ্রুতই ফোনসহ অপরাধীকে সনাক্ত করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা।
তবে এ ঘটনার দায় নিতে রাজি নয় চন্দ্রিমা থানা, পাল্টা অভিযোগ তালাইমারি ফাঁড়ির বিরুদ্ধে । থানা এবং ফাঁড়ির মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ । এ ঘটনাকে ঘিরে নগরীর চন্দ্রিমা থানাধীন ভদ্রা এলাকায় এখন মুল আলোচিত ঘটনায় পরিনত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৃত মুর্শিদার স্বজন প্রতিবেদককে বলেন, আত্মহত্যার দিন স্থানীয়রা ঘটনাটি জানতে পারলে নগরীর চন্দ্রিমা থানাধীন তালাইমারী পুলিশ ফাঁড়িতে জানায়। তাৎক্ষনিক চন্দ্রিমা থানার অফিসার্স ইনর্চাজ ইমরান, তালাইমারী ফাঁড়ীর ইনচার্জ আশিকুল রহমান সঙ্গীয় র্ফোস নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। মৃত মুশিদার ঘর ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় তালাইমারী ফাঁড়ীর ইনচার্জ ও থানার অফিসার্স ইনর্চাজের উপস্থিতিতে ঘরের তালা ভাঙ্গে একজন পুলিশ সদস্য। ভেতর থেকে লাশ বের করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আলামত হিসেবে মেয়ের বাবার কছে থেকে মৃত মুর্শিদার মোবাইল ও ওড়না জব্দ করেন। তবে জব্দকৃত আলামতের তালিকা সহ কোন প্রমাণপত্র প্রদান করা হয়নি মৃতের স্বজনদের।
তিনি আরো বলেন, তরুনীকে দাফনের পর তদন্ত কর্মকতার কাছে জব্দকৃত ফোন নেয়ার জন্য ফোন দেয় মৃতের স্বজনেরা। সেই সময় ফোনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়নি। সেই পুলিশ কর্মকতা বলে, “ফোন হারাবে না পাওয়া যাবে। আমাদেরই কারো কাছে আছে হয়তো। তদন্ত শেষ হলে দিয়ে দিবো”। কিন্তু তার কয়েকদিন পর মৃতের বাসায় কুলখানির আয়োজন করা হয়। সেইদিন সকালে সিভিলে দুইজন পুলিশ পরিচয়ে আমাদের বাসায় আসে। আমাদেরকে বলে যে, আপনারা কি আপনাদের স্মার্ট ফোনটি ফিরে পেয়েছেন? আমরা বলি যে না আমাদেরকে কোনো ফোন ফেরত দেয়া হয়নি। সেই দুইজন পুলিশ তখন চলে যায়।
তারপর আসরের আযানের পর মিলাদ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে বাসায় আসে চন্দ্রিমা থানার অফিসার্স ইনচার্জ ইমরান। তখন তিনি (ওসি ইমরান) আমাদের বলেন, দেখো তোমাদের ফোন থেকে আমার নামে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ নেটে ছড়ানো হচ্ছে। ওসি তখন কান্না করার মতো হয়ে পরে। সেই সময় আমরা আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাবেক কাউন্সিলর খলিলুর রহমানকে জানাই। তিনি এসে সংক্ষেপে মিলাদের আয়োজন শেষ করে। এরপর সকলে আমরা তার (সাবেক কাউন্সিলর) চেম্বারে গিয়ে কথা বলি। তবে, এখনো ফোনটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আর মেয়ের বাবাতো অক্ষরজ্ঞানহীন বয়স্ক মানুষ, তার উপরে মেয়ে হারানোর বেদনা তাই তাৎক্ষনিক যে পুলিশ সদস্য মোবাইল ফোন ও ওড়না আলামত হিসেবে নিয়েছে তাকে চিনতে পারছেনা।
তবে, মুর্শিদার বাবার একটি ভিডিও বার্তা প্রতিবেদকের কাছে আসে সেখানে তাকে বলতে দেখা যায় যে, ফোনটি তিনি ওসি ইমরানের হাতে দিয়েছে। কিন্ত, এ বিষয় নিয়ে প্রতিবেদকের মুখোমুখি হলে মুর্শিদার বাবা জানায়, আমি ফোন কাকে দিয়েছি সেটা জানি না। আমি তাকে চিনতে পারছি না। তবে তিনি পুলিশের পোশাকেই ছিলেন।
এদিকে মোবাইল নিয়ে শুরু হয় আরেক বিপত্তি, চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমরান জানায়, মোবাইলটি আমি হাতেই ধরিনি। আবার সেই মোবাইল থেকেই আমার নামে ৩২ লক্ষ টাকা আদান-প্রদানের অভিযোগ করা হয়েছে। আর এই তথ্য গুলো আবার বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। আমি এই মোবাইলের বিষয়ে কিছুই জানি না।
ওসি ইমরানের বক্তব্যের জেরে তাকে প্রশ্ন করা হয় নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলা কার? তিনি এ বিষয়েও সঠিক কোনো তথ্য প্রমান উপস্থাপন করতে পারেনি। তদন্ত কর্মকতা থাকার পরেও একই বাসায় বারবার যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ইমরান বলেন, মৃতের ফোন থেকে আমার নামে বিভিন্ন মিথ্যা বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর তাই আমি সেখানে যায়।
ওসি ইমরানের মতো প্রশাসনের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিকে নিয়ে মিথ্যা কুৎসা রটানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ কে করতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি, বিভিন্ন ইংগিতে তার কয়েকজন সহকর্মীর বিষয়ে বলেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এলাকাটিতে জমি জমা সংক্রান্ত নানান জটিলতায় তার (ওসির) শক্ত অবস্থানের কারণেই কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য এমন কাজ করতে পারে।
তবে চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) ইমরানের বক্তব্যের সূত্র ধরে তথ্য অনুসন্ধানে নগরীর তালাইমারি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আশিকুরের সাথে কথা হলে তিনি জানায়, আত্মহত্যার ঘটনার দিন তালাইমারী ফাঁড়ীর ভবনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে বুঝে নেয়ার একটি আনুষ্ঠানিকতা ছিল। তাই সেই দিন ফাঁড়িতেই অবস্থান করছিলেন ওসি ইমরান। তাকে ঘটনাটি জানানোর পর তিনি ঘটনাস্থলে যেতে নিষেধ করে। তবে আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে সেখানে যেতে চাইলে ওসিও আমার সাথে সেখানে যায়।
ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ঘরটির দরজা ভাঙ্গা পর্যন্ত আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট আমি অবস্থান করি। তারপর সিনিয়র অফিসারদের ফোন পেয়ে আমি আবারো ফাঁড়িতে চলে আসি। তবে, ওসি স্যার সেখানেই থেকে যায়।
তিনি আরো বলেন, ফাঁড়িতে আসার কিছুক্ষন পর আবারো ওসি স্যার আমাকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে ডাকে। সেখানে গিয়ে লাশ হাসপাতালে পাঠানো পর আমি আর ছিলাম না। আর এ ঘটনার সাথে মোবাইলের যে সম্পর্ক সেটি আমার জানা নেই। কারণ, এই ঘটনার তদন্ত কর্মকতা অন্যজন। তবে, আমার নামে যদি কেউ কোনো মিথ্যাচার করে তবে সেটা হবে বোকামী। ঘটনার দিন থেকে আজ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত সকল কাজের প্রমান আমার কাছে আছে।
অন্যদিকে মোবাইলের বিষয়ে ঘটনাটির তদন্ত কর্মকতা এস আই প্লাবন বলেন, আমি গত ১তারিখ থেকে ঢাকায় অবস্থান করছি। তাই এ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। তবে, শুনলাম যে মৃতের মোবাইল ব্যাবহার করে ওসি ইমরান স্যারের নামে বিভিন্ন খারাপ মন্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। কে বা কারা এই কাজ গুলো করছে তা আমরা এখনো বের করতে পারিনি। এটির সুষ্ঠ তদন্ত করা হবে।
তবে জমি জমা নিষ্পত্তি নিয়ে ওসি ইমরানের ভূমিকা নিয়ে নিজের প্রশংসা করলেও প্রতিবেদকের নিকট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাক্তির দেওয়া তথ্য মতে জানা যায় এলাকার কিছু অসাধু ব্যাক্তিদের সাথে যোগসাজশ করে জমি সংক্রান্ত মামলা মিমাংসার জন্য মোটা অংকের আর্থিক লেনদেন করতেন ওসি।
এছাড়াও মামলা রুজু করা নিয়ে সাদিয়া হত্যা মামলার জন্য সাহেব বাজার এলাকায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসুচি পালন করছে এলাকাবাসী যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তারপর বাধ্য হয়ে প্রায় ১০/১২ দিন পরে ওসি থানায় মামলা গ্রহণ করেন। অনেক মামলা থানায় না নিয়ে আদালতে মামলা করার জন্য ফেরত পাঠাতেন।
প্রসঙ্গত, এলাকাবাসী ও সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৃত মুর্শিদার ঐ এলাকার রিতু নামের একটি মেয়ের সাথে বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রিতুর স্বামী অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করে। তাদেরকে প্রায়ই বিভিন্ন ছেলেদের সাথে ঘুরতে দেখেছে এমনকি বাইকে করে বাসায় রেখে যেতে দেখেছে তারা। রিতুর দেওয়া তথ্য মতে, মুর্শিদার একজন ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তবে রিতু ছেলের সম্পর্কে কোন কিছু জানেনা বলে দাবি করে। রিতুর সাথে ঘুরে বেড়ানোর জন্য মুর্শিদার মায়ের সাথে প্রায়ই মুর্শিদার ঝগড়া হতো। রিতুর বক্তব্য, সে (মুর্শিদা) মাঝে মাঝে ঘুমের ঔষধ খেতো। মৃত্যুর আগের দিন অসুস্থ থাকার জন্য ডাক্তারের কাছে গেছিলো মুর্শিদা, এবং মৃত্যুর আগের রাতে প্রায় ১১/১২ টায় রিতুর সাথে ইমুতে কথা হয়েছিলো মুর্শিদার।
মুর্শিদার মা জানান, তার মেয়ে রিতুর সাথে ঘুরে বেড়াতো আর নেশা করতো, রিতু মেয়েটা ভালো না সে আমার মেয়েকে খারাপ পথে নিয়ে গেছে। আমি তাকে এটা নিয়ে নিষেধ করলে উল্টো আমাকে মারধর গালাগালি করেতো । আত্মহত্যা করার আগের রাতেও আমাকে মেরেছে। আর প্রায় সময় সে আমাকে আত্মহত্যা করার ভয় দেখাতো। সত্যিই আমার মেয়ে তাই করে ফেললো। সেইদিন সকাল থেকে তার ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় অনেক ডাকা ডাকি করে যখন ভিতর থেকে দরজা খুলছিলো না তখন থানায় ফোন দিয়ে পুলিশকে ডেকে ঘরের দরজা ভেংগে তার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। তবে, বুধবার ময়না তদন্ত শেষে লাশ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন।
জানা যায়, মৃত্যুর পূর্বে মুর্শিদা ফেসবুক আইডি নষ্ট করে। তার বান্ধবীর অসংগতিপূর্ন কথা-বার্তা আত্নহত্যা নাকি আত্ম-হত্যাতে বাধ্য করা এসব বিষয় নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করলেও নেওয়া হয়নি আইনি কোন পদক্ষেপ । তারপর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তবে তার পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো মামলার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
সবমিলিয়ে আলোচনায় আসে, তরুনী মুর্শিদার রিয়েলমি ব্যান্ডের নতুন স্মার্টফোন ও গ্রামীন-রবি সিমকে ঘিরে। যার জন্য দিশেহারা চন্দ্রীমা থানা। প্রতিবেদন সংগ্রহ করা অবস্থায় ১৯ তারিখ রাত ৯/১০ টার সময় গণমাধ্যম মারফত জানা যায় চন্দ্রীমা থানা সহ কয়েকটি থানার ওসি দের বিভিন্ন থানায় বদলি করা হয়েছে।
সবকিছুর পরেও নিখোঁজ স্মার্ট ফোন উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত হচ্ছে না রহস্যের সমাধান আলোচনায় থাকছে ফোনটি গেলো কোথায় আর কেইবা এসব তথ্য প্রকাশ করছে?