রবিবার, ৪ জুন ২০২৩
গাজী আরিফুর রহমানঃ
কী ভয়ংকর বীভৎস দৃশ্য! কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন! সবার বাঁচার আঁকুতি। আর্তনাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেউ কাউকে দেখতে পারছিলেন না। কানে ভাসছিল শুধু আর্তনাদ। সেই আতঙ্কিত বাঁচার আর্তনাদ এখনও কানে বাজে সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে বেঁচে ফেরা মানুষ গুলোর।
ট্র্যাজেডির আজ এক বছর। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভোর ৩টার দিকে কয়েকশ যাত্রী বহনকারী বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৯ জন। এখনো অগ্নিকাণ্ডের আটকে থাকা সেই ৪-৫ ঘণ্টা মৃত্যুকূপ মুহূর্ত ভুলতে পারেননি তারা।
লেলিহান শিখা আর লঞ্চে আটকা পড়া যাত্রীদের আর্তচিৎকারের কথা মনে পড়ে এখনো আঁতকে ওঠেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও। সুগন্ধা পাড়ের সেই দিয়াকুল গ্রামের মানুষদের ওই সব দুঃস্মৃতি আজো পীড়িত করে। প্রতিক্ষণ ভয়ংকর স্মৃতি ভেসে ওঠে তাদের মানসপটে।
সেই ভয়ংকর দিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের গার্মেন্টসকর্মী আরিফা আক্তার। ধোঁয়ার মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা আটকা থাকার কারণে শ্বাসকষ্ট সমস্যায় ভুগছেন এখন। স্থায়ী সমস্যা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই ছুটতে হয় চিকিৎসকের কাছে। কোথাও আগুন দেখলেই আতঙ্কিত হন। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের দেড়-দুই ঘণ্টা পর বাঁচার আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। যারা আটকা ছিলেন, সবাই যে যার স্বজনের কাছে ফোন করে দোয়া প্রার্থনা করছিলেন এবং ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলেন।
মৃত্যুকূপ থেকে উদ্ধার হওয়া আরেক যাত্রী বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের এনামুল হক জানান, সাড়ে তিন ঘণ্টা মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। দৈনন্দিন কাজের কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও সেই ভয়ংকর স্মৃতি ভোলার নয়। প্রায় প্রতিদিন সেই দুঃসহ স্মৃতি ভেসে ওঠে। আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে সেদিনের ভীতিকর পরিস্থিতি।
মির্জাগঞ্জ উপজেলার সনাতন হালদার বলেন, আমি একাই সাঁতার জানি। সাঁতার না জানা বোন মনিষাকে নিয়ে ও ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। কয়েকবার বোনের হাত ছুটে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কাছাকাছি থাকায় সন্ধান পাই। বহু কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই।সৃষ্টিকর্তা আমাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছিলেন তখন। নদীতে ঝাঁপ না দিলে আগুনের লেলিহানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। পৃথিবীর আলো আর দেখতে পেতাম না।
গত বছর ২৪ ডিসেম্বর ভোরে দুর্বিষহ এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঝালকাঠির সদর উপজেলার সুগন্ধার পাড়ের দিয়াকুল গ্রামের বাসিন্দাদের। তাদের সামনেই পুড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় অর্ধশত যাত্রী।
দিয়াকুল গ্রামের রহিম হাওলাদার বলেন, ওইদিন ভোররাতে নদীর মধ্যে চিৎকার শুনে জেগে উঠি। বাড়ির অন্যদের নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি লঞ্চটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাড়ির সবাই ছুটে যাই। লঞ্চটি মাঝ নদীতে থাকায় কিছুই করতে পারেনি। লঞ্চটি পাশে আসার পর নদীতে ঝাঁপ দেওয়া যাত্রীদের উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। এখনো নদীর পাড়ে গেলে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে।
ওই গ্রামের স্কুলছাত্র জাবেদ হাওলাদার বলেন, নদীতে ভাসতে থাকা দগ্ধ এক ব্যক্তিকে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করি। এরপর আরও বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করি। এখনো নদীতে লঞ্চ যাওয়ার শব্দ শুনলেই ওই দিনের ঘটনা মনে পড়ে যায়।
একই গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী রহমান সরদার বলেন, এমন নির্মম মৃত্যু যেন কারো ভাগ্যে না জোটে। ওই ঘটনায় গ্রামের প্রায় সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এখনো ওই দিনের ঘটনা মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন সুগন্ধায় যাত্রী পারাপারের ট্রলারের চালকরা। তারাই মূলত অধিকাংশ যাত্রীকে নদী থেকে উদ্ধার করে তীরে এনেছিলেন। পরে তাদের সেখান থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
সোহেল রানা নামে একজন ট্রলার চালক বলেন, খুব ভোরে খেয়াঘাটে আসি। এরপরই দুর্ঘটনার খবর শুনতে পেয়ে দ্রুত ট্রলার নিয়ে লঞ্চটির কাছে যাই। এরপর কুয়াশার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করে তীরে আনি। এক বছর পার হলেও এখনো ওইদিনের ঘটনাগুলো ভুলতে পারিনি।
সেদিনের উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাকরি জীবনে কখনোই এমন দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়নি। কখনো প্রত্যাশাও করিনি। ঘন কুয়াশা আর নৌ ফায়ার স্টেশন না থাকায় উদ্ধার কাজ পরিচালনায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর লঞ্চের মালিকসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে ঝালকাঠি থানায় দায়ের করা মামলা ঢাকার নৌ আদালতে বিচারাধীন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নিহত সবার ডিএনএ রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। সেগুলো পাওয়ার পরে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এছাড়াও এমভি অভিযান-১০ এ অগ্নিকাণ্ডে যাত্রীদের মৃত্যুর ঘটনায় লঞ্চটির মালিক মো. হাম জালাল শেখ এবং ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বরগুনার সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আইনজীবী নাজমুল ইসলাম নাসির বাদি হয়ে বরগুনা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করেন।
প্রসঙ্গত, গত ২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোররাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ৪৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে ৪১ জনেরই বাড়ি বরগুনায়। এদের মধ্যে ১৮ জনকে বিভিন্ন নমুনা দেখে শনাক্ত করে নিয়ে গেছে স্বজনরা ৷ বাকি ২৩ জনকে বরগুনার পোটকাখালী গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে। পরে ওই ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনকে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করতে পেরেছে পরিবার। তবে এখনও কাউকে হস্তান্তর করা হয়নি। এদিকে শনাক্ত করে নিয়ে যাওয়া ১৮ মরদেহের পরিবারকে নৌ পরিবহন তহবিল ট্রাস্টি বোর্ড হতে দেড় লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। ট্র্যাজেডির এক বছর অতিবাহিত হলেও নিখোঁজ রয়েছে এখনও ১৬ জন।