ইসরাইলি আগ্রাসন: কী আছে পশ্চিম তীরের ভাগ্যে? - Pallibarta.com

শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

ইসরাইলি আগ্রাসন: কী আছে পশ্চিম তীরের ভাগ্যে?

ফিলিস্তিনে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা নতুন কিছু নয়। গত সাত দশক ধরেই এটা চলছে। কিন্তু সম্প্রতি তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রতিটি এলাকায়, প্রতি পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে নিরীহ ও নিরস্ত্র নাগরিকদের। কোনো রকম উসকানি ছাড়াই আটক করে জেলে ভরছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, সম্পদ নষ্ট করছে।

এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ইসরাইলি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, সেই বিস্ফোরণ কীভাবে ঘটবে বা তার মাত্রা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে গত এক বছরে বেশ কিছু ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও স্থিতাবস্থায় যে টানাপোড়েন চলছে, তার মধ্যদিয়ে একটা গুরুতর পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অঞ্চলটি।

যেমনটা বলছেন, হেবরন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বেলাল শোবাকি। সম্প্রতি আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শোবাকি বলেন, ‘পশ্চিম তীর যে পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে, তাতে আরেকটা ফিলিস্তিনি অভ্যুত্থান ও [ইসরাইলের] দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে নতুন সংঘাত অনিবার্য। আমার বিশ্বাস, পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ এবং ২০২৩ সালেই তা ঘটবে।’

বিষয়টা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষও জানে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ শিক্ষক। আর সে কারণে আগেভাগেই তা থামিয়ে দেয়ার সব চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। শোবাকির কথায়, ‘ইসরাইলি সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর অনুমান, পশ্চিম তীর শেষ পর্যন্ত ফুসে উঠতে বাধ্য। আর তাই এ পরিস্থিতিটিকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের কৌশল প্রয়োগ করে দমানোর চেষ্টা করছে।’

মধ্যপ্রাচ্য বা আরবের প্রাচীনতম একটি ভূখণ্ড ফিলিস্তিন ইসলামের ইতিহাসের একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে। অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত এ ভূমিতে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল আকসা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল ত্বরান্বিত হয়। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ তারাই নিজভূমে পরবাসী।

নিজেদের হারানো ভূমি, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের। শত সংগ্রামের মধ্যেও তারা রক্ষা করার চেষ্টা করছে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

এক সময় ফিলিস্তিন বলতে তৎকালীন বিশ্বে প্রভাবশালী বিস্তৃত এক অঞ্চলকে বুঝালেও আজ তা শুধুমাত্র দুই চিলতে জমিন। সেটাও আবার প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত হচ্ছে ইসরাইলি আগ্রাসনে।

মাত্র ৬ হাজার ২০ কিলোমিটার আয়তনের ভূমি আজকের ফিলিস্তিন। যার একাংশ অধিকৃত পশ্চিম তীরের আয়তন ৫ হাজার ৬৫৫ ও অপরাংশ গাজা উপত্যকার আয়তন ৩৬৫ কিলোমিটার। ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিম তীর ইসরাইলের দখলে রয়েছে। পশ্চিম তীর বলতেই ইসরাইলি আগ্রাসন, সহিংসতা, হামলা ওমামলা, জুলুম-নিযার্তন, হত্যা ও গ্রেফতার।

তবে গত বছরের শুরু থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বাহিনীর নতুন সহিংসতা-নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। এই সময়ে প্রায় ১৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই শিশু ও কিশোর। এছাড়া আরও অসংখ্য ফিলিস্তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন।

জাতিসংঘের এক হিসেবে, গত বছর (২০২২) ইসরাইলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় যত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, তা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেনা ও পুলিশি হামলার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ওপর সেটেলার বা অবৈধ ইহুদি অধিবাসীদের হামলার ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

চলতি বছরও তথাকথিত সেই সেনা অভিযান ও হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। বছরের প্রথম মাসের প্রথমার্ধেই ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার সংখ্যা ১৩ জনে দাঁড়িয়েছে।

সবশেষ গত সোমবার (১৬ জানুয়ারি) পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনি শিশুকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা। এ হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে শনিবার (১৪ জানুয়ারি) পশ্চিম তীরের উত্তরে জেনিন শহরের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে দুই যুবক নিহত হয়।

গত বছর ইসরাইলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগই বেসামরিক নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ। এরপরও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বলছে, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন দমাতেই অভিযান চালানো হচ্ছে।

এদিকে গত মাসে ইসরাইলে নতুন জোট সরকার গঠন হয়েছে। একে দেশটির এ যাবৎকালের সবচেয়ে কট্টর ও উগ্র সরকার বলে অভিহিত করেছেন পর্যবেক্ষকরা। উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিক বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন ওই সরকারে জায়গা পেয়েছেন একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি। যার মধ্যে চরমপন্থি ইহুদি ধর্মগুরু ও ‘জিউইশ পাওয়ার’ দলের নেতা ইতামার বেন-গভিরও রয়েছেন।

নেতানিয়াহু সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী দায়িত্ব পেয়েছেন বেন গভির। দায়িত্ব পেয়েই সম্প্রতি মুসলিমদের পবিত্র আল আকসা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করেন তিনি। যা নতুন করে পুরো অঞ্চলে চরম সংঘাতের আশঙ্কা উসকে দিয়েছে।

বেন গভিরের আল আকসা সফরকে ‘রেডলাইন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর কঠোর নিন্দা জানায় মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ফিলিস্তিনি নেতারা তার এমন কর্মকাণ্ডকে অপ্রত্যাশিত উস্কানি বা প্ররোচনা বলে অভিহিত করেন।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘মসজিদ চত্বরে চরমপন্থি মন্ত্রী বেন গাভির প্রবেশের কড়া নিন্দা জানায় ফিলিস্তিন। একই সঙ্গে এটা যুদ্ধে উসকানি ও বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা। আল আকসা মসজিদে বেন গভিরের সফরকে এই মসজিদ ইহুদিদের উপাসনালয় বানানোর একটি ফন্দি হিসেবে অভিযোগ করেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ সত্যয়ে।

সতর্কতা উচ্চারণ করেছে গাজা উপত্যকায় ক্ষমতায় থাকা যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। তারা বেন গভির এই উদ্যোগকে ‘রেডলাইন’ অতিক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে এসব সমালোচনাকে নেতানিয়াহুর সরকার গায়ে মাখছে বলে মনে হয় না।

কেননা বেন গভিরের প্ররোচনায় নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ৬০ দিনের মধ্যে তিনি বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা কয়েক ডজন বসতিকে বৈধতা দেবেন। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

নতুন এই কট্টরপন্থি সরকারের অধীনে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর হামলা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারে আরেক উগ্র ডানপন্থি অংশীদার বেজালের স্মোট্রিচের ‘রিলিজিয়াস জায়োনিজম’।

তাদের হাতে পশ্চিমতীরের প্রশাসনিক ক্ষমতা তুলে দিতে সম্মত হয়েছেন নেতানিয়াহু। রিলিজিয়াস জায়োনিজম সব অবৈধ বসতিকে শুধু বৈধতাই দিতে চায় এমন নয়। একই সঙ্গে তারা পশ্চিমতীরে ‘এরিয়া সি’তে ফিলিস্তিনিদের অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করে দিতে চায়।

এর অর্থ হলো ইসরাইলে নতুন সরকারের অধীনে এমন নতুন নতুন ‘ফার্ম আউটপোস্টের’ সংখ্যাই শুধু বাড়বে এমন নয়। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীরে যেসব নতুন ও পুরনো সহায় সম্পদ আছে, তা গুঁড়িয়ে দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিস্ফোরণের সমূহ সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা।

আরো পড়ুন ...

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১